১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাঙনে দিশেহারা মানুষ

তলিয়ে আছে ঢাকার নিম্নাঞ্চল
নদীভাঙনে ঘরবাড়ির সামগ্রী সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের নতুন চর খাড়াকান্দি এলাকার লোকজন : নয়া দিগন্ত -

তীব্র নদীভাঙনের ভয়াবহতা চলছে দেশের নদীতীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায়। উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির কারণে এর আগে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে কয়েক দফা বন্যার পর এখন ভাঙনের আতঙ্ক জেঁকে বসেছে নদীপাড়ের মানুষের মনে। দেশে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে বন্যা, তার সাথে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। পানি নেমে গেলে ভাঙন আরো তীব্র হওয়ার আভাস রয়েছে, যা করোনাভাইরাস মহামারীকালে লাখ লাখ মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়ানোর আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে বন্যা পরিস্থিতিতে ৭ হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। তিন শতাধিকের বেশি পরিবার ঘর ছেড়ে ব্রিজ ও উঁচু রাস্তায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ধলেশ্বরীর ভাঙনের তীব্রতায় গত তিন দিনে বিলীন হয়েছে এক ইউনিয়নের ১০টি বাড়ি। হুমকিতে রয়েছে আরো ৫০টি স্থাপনা। শেরপুরের ভোগাই নদীর ভাঙনে বিলীনের উপক্রম নালিতাবাড়ী পৌরসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে যমুনার শাখা নদীর ভাঙনে বিলীনের পথে গুলুঘাট নামের একটি গ্রাম।
এ দিকে দেশের বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এখনো বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে থাকা তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার পানি। ফলে নদ-নদী তিনটির উপচে পড়া পানিতে প্লাবিত ঢাকার নিম্নাঞ্চল। তবে বিপদসীমার নিচে রয়েছে বুড়িগঙ্গার পানি। গত এক দিনে বালু, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি কিছুটা কমলেও বেড়েছে তুরাগের পানি। অন্য দিকে তিনটি নদ-নদীর পানির উচ্চতার কারণে রাজধানীর প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে নামছে না পানি।
হুমকির মুখে মাওয়া ১ ও ২ নং ফেরিঘাট
মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় শিমুলিয়া ফেরিঘাট এলাকায় পদ্মার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গত এক সপ্তাহের অব্যাহত ভাঙনে এবং তীব্র স্রোতে শিমুলিয়ার দু’টি ফেরিঘাট এবং কুমারভোগে পদ্মা সেতুর ইয়ার্ডে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাপক এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বাঁশ, জিউ ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় দ্রুত স্থায়ীভাবে নদী শাসন না করলে আগামীতে পদ্মা সেতুর পাশের এলাকা এবং নদীভাঙনের হুমকিতে থাকা ১ নম্বর ও ২ নম্বর ফেরিঘাটসহ বিআইডব্লিউটিসি ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াতে ব্যস্ততম এ নৌ-রুট বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, প্রমত্তা পদ্মার করাল গ্রাসে শিমুলিয়ায় কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌ-রুটের ৩ নম্বর ফেরিঘাট ৩১ জুলাই নদীতে বিলীন হয়ে যায়। গত ৪ আগস্ট আবারো আকস্মিক ভাঙনে ৪ নম্বর ফেরিঘাট এবং কুমারভোগের পদ্মা সেতুর ডকইয়ার্ডও প্রায় ১০০ মিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এতে পদ্মা সেতুর মালামালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে ফেরিঘাট এলাকায় পদ্মা নদী প্রায় ৬০০ ফুট ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
গত শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, ২ নম্বর ঘাট থেকে ২০০ মিটার দূরে নদী এক হাজার মিটার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। যেকোনো সময় নদীর তীব্র স্রোতে সোজা প্রবাহিত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে যেতে পারে। এর আগে ২০১৫ সালের এ সময় পদ্মার ব্যাপক ভাঙনে কুমারভোগের ডকইয়ার্ডে আকস্মিক ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছিল।
সংশ্লিøষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, পদ্মার প্রচণ্ড ঘূর্ণিস্রোতের তাণ্ডবে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের মালামাল ওঠা-নামার জন্য নির্মিত চারটি জেটির মধ্যে তিনটি জেটি নদীতে ভেঙে পড়ে। প্রবল ঘূর্ণিতে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে মিক্সার প্লান এলাকাটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। নদী প্রায় ৩০-৪০ মিটার ভেতরে ঢুকে পড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিøউটিসির এক প্রকৌশলী বলেন, সর্বনাশা পদ্মার চরিত্র ভিন্ন প্রকৃতির। নদীর স্রোত বাধা পেলে পাশের এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। বিচিত্র চরিত্রের পদ্মা নদীর পাড় নিচ থেকে তলদেশের মাটি মুহূর্তের মধ্যে ৫০ মিটার পর্যন্ত সরে যায় এবং ধসে পড়ে। ফেরিঘাট এলাকা থেকে প্রায় ১৫ শত মিটার দূরে নদীর মাঝে বিদ্যুতের প্রায় ১৬টি পিলার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে স্রোতে বাধা পেয়ে ভেতরে ঢোকার আশঙ্ক রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান এবং বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
কাশিয়ানীতে ব্রিজ ও রাস্তায় থাকছে মানুষ
কাশিয়ানী (গোপালগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, কাশিয়ানীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। প্রায় সাত হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। তিন শতাধিকের বেশি পরিবার উঁচু ব্রিজ, কালভার্ট, পাকা রাস্তা ও আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার নি¤œাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সিংগা, হাতিয়াড়া, পুইসুর, নিজামকান্দি, মাহমুদপুর, পারুলিয়া, মহেশপুর, সাজাইল ইউনিয়নের মানুষ বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। পারুলিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পরিবার গৃহপালিত হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল নিয়ে এলাকার উঁচু ব্রিজের উপরে আশ্রয় নিয়েছে। অধিকাংশ পাকা রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে উপজেলা ও জেলার যোগাযোগ বিছিন্ন হতে পারে। এ দিকে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিরাণ হোসেন জানান, ৭ হাজার পরিবার পানিবন্দী এবং সাড়ে তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্র ও উঁচু রাস্তার উপরে বসবাস করছে। সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
সিরাজদিখানে ভাঙনে ১০ বাড়ি বিলীন : হুমকিতে বহু স্থাপনা
সিরাজদিখান (মুন্সীগঞ্জ) সংবাদদদাতা জানান, সিরাজদিখানে ধলেশ্বরী নদীর পানি কমার সাথে সাথে তীব্র ¯্রােতের কারণে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। গত তিন দিনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে উপজেলার চিত্রকোট ইউনিয়নের গোয়ালখালী ডাকপাড়া গ্রামের ১০টি বাড়ি। হুমকির মুখে আরো ৫০টি বাড়িসহ মসজিদ, বিদ্যুৎ টাওয়ার এবং সরকারি স্থাপনা। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব এলাকায় কোন ধরনের সাহায্য আসছে না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। অনেক পরিবার তড়িঘড়ি করে ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধলেশ্বরীর ভাঙনে দিশেহারা গোয়ালখালী ডাকপাড়া গ্রামের মানুষ। ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই। প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এলাকার যুবকরা চাঁদা তুৃলে কিছু বাঁশ দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, হঠাৎ নদীতে পানি কমে ¯্রােত বাড়ায় ভাঙনের মুখে পড়েছেন তারা। বসতভিটাসহ সবই নদীতে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর বড় বড় পাড় ভেঙে পড়ছে। প্রায় ১০টি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। চিত্রকোট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামসুল হুদা বাবুল বলেন, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশফিকুন নাহার জানান, বিষয়টি আমি জেনে সাথে সাথেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে কর্মকর্তা এসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ^াস দিয়েছেন।
নালিতাবাড়িতে ব্যাপক ভাঙন
নালিতাবাড়ী (শেরপুর) সংবাদদতা জানান, নালিতাবাড়ি পৌরসভার আড়াইআনি ও চকপড়া অংশ ভোগাইনদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে। স্থায়ী বাঁধ না থাকায় মূল্যবান জমি ও বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হতে যাচ্ছে। বিলীন হতে পারে তারাগঞ্জ ফাজিল মাদরাসাসহ বেশ কয়েকটি বাড়িঘর। ভোগাই নদীপাড়ে বসবাসরত অনেকে অভিযোগ করেন, নদীর অপরপ্রান্তে তারাগঞ্জ বাজার অংশে স্থায়ী বাঁধ থাকার পরও ধনাট্য এক ব্যক্তি নদীগর্ভে প্রায় ৫ হাজার বালির বস্তা ফেলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করায় এ ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। নালিতাবাড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুকছেদুর রহমান লেবু বলেন, নদীতে বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
দেওয়ানগঞ্জে গুলুঘাট গ্রাম বিলীনের পথে
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, দেওয়ানগঞ্জে নদী ভাঙনে গুলুঘাট নামে একটি গ্রাম বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের চুনিয়াপাড়া গুলুঘাট গ্রামটিতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। অদূরের যমুনা নদী থেকে চৌধুরী বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি শাখা নদী হঠাৎ ভাঙনমুখী হয়ে গেছে। যমুনা থেকে প্রচণ্ড ¯্রােতের পানি গুলুঘাট ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পূর্বের ব্রহ্মপুত্র নদে। চুনিয়াপাড়া গ্রামের গুলু ঘাট ব্রিজ সংলগ্ন এই গুলুঘাট গ্রাম। গত ১ সপ্তাহে গ্রামটির ৮-১০ পরিবারের বাড়িঘর নদীতে ভেঙে গেছে। পুরো গ্রামটি বিলীন হওয়ার উপক্রম। গত শুক্রবার গ্রামের আ: রহমান, তার পুত্র ইরফান আলী, চুক্কা আলীসহ ৮-১০ পরিবারের বাড়ি নদীতে ভেঙে গেছে। আশ্রয়হীন এসব পরিবার অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আরো ২০ পরিবারের বাড়িঘর যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। এলাকাবাসী জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধের দাবি জানিয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement