১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

মধ্যাঞ্চলে বাড়ছে পানি

অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত উপকূলের নিম্নাঞ্চল; বন্যাদুর্গত এলাকায় পানি কমলেও ভাঙন অব্যাহত
রাজধানীর ডেমরার কাজলা এলাকায় বন্যার পানি এখনো নামেনি। রাস্তায় জমে থাকা পানিতে গোসল করতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় শিশু-কিশোরদের : আবদুল্লাহ আল বাপ্পী -

দুর্গত বিভিন্ন জেলায় নদ-নদীর পানি আর বেশি না বাড়লেও ভাঙনের ভয়াবহতা চলছে অনেক স্থানে। এর মধ্যে ১৩ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যার উন্নতি হলেও গত ক’দিনে দেশের মধ্যাঞ্চলের নদীতে পানি বেড়ে ভোগান্তি আবারো বাড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েক দফা বন্যায় দেশের ৩৪ জেলায় দেড় লাখ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে কৃষি বিভাগ। এ দিকে উপকূলীয় কয়েক জেলায় অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। কোথাও কোথাও সড়ক ভেঙে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজধানীর নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি বেড়েই চলছে : ডুবে গেছে রাজধানীর নিম্নাঞ্চল। বাসাবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে মানুষ। প্রায় অর্ধমাস ধরেই এই এলাকায় বন্যার পানি জমেছে। পানি কমার আপতত কোনো লক্ষণ না থাকায় মানুষ অন্যত্র আশ্রয়ের জন্য চলে যাচ্ছে। যারা এখনো আছেন তারা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। যাতায়াতসহ সবকিছুতেই তাদেরকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
টানা বর্ষণে সৃষ্টি হওয়া বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে রাজধানীর নিম্নাঞ্চল। রাজধানীর আশুলিয়া, তুরাগ, বাড্ডা, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর এলাকায় ইতোমধ্যে বন্যার পানি ঢুকে গেছে। কোনো কোনো এলাকার বাজারঘাট পর্যন্ত ডুবে গেছে। ডেমরার কোনাপাড়া, কাজলা, জুরাইনের বিভিন্ন স্থান, শ্যামপুরের নিচুস্থানের বাজারঘাট এখন পানির নিচে। মাদারটেক, খিলগাঁও, বাড্ডা ও সাঁতারকুলের অনেক বাসাবাড়ির নিচ তলায় প্রায় ১৫ দিন ধরে পানি জমে আছে। রাজধানীর ডেমরার ছোট পাইটি, বড় পাইটি, কাজলা, বামইলসহ অনেক এলাকার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এলাকার বাসিন্দারা জানান, ১৯৯৮ সালের পর ঢাকায় এমন বন্যা হয়নি। অনেক বাড়িঘরে পানি ঢুকে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে অর্ধমাস হয়ে গেছে। বন্যার পানির কারণে ওই এলাকার অনেকে এবার কোরবানি পর্যন্ত করতে পারেননি। পশু জবেহ করার স্থান ছিল না। আবার কোথাও কোথাও সপ্তাহখানেক হলো বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার অনেক জায়গায় বাড়িঘরে পানি প্রবেশ না করলেও আশপাশে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, এই পানি কবে কমবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পানি আরো দিন দিন বাড়ছে। ফলে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। উঁচু ভবনগুলোর বাসিন্দারও ভোগান্তিতে আছেন। প্রধান গেট দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করার উপায় নেই অনেকের।
কুড়িগ্রামে ভাঙন আশঙ্কায় নদীতীরের মানুষ
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উন্নতি হয়েছে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির। কিন্তু পানি কমার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের সূত্রমতে, ইতোমধ্যে জয়কুমার, থেতরাই ও কালিরহাটসহ অনেক জায়গায় ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সারডোব, মোগলবাসা ও নুনখাওয়া এলাকা ভাঙনে পড়েছে। মোগলবাসা ইউনিয়নের অনেকে বলেন, নদীর পানি নেমে যাওয়ার ফলে নদীর কাচারে ভাঙন শুরু হয়। প্রতি বছরই এভাবে নদীতে চলে যায় অনেক বাড়িঘর ও আবাদি জমি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ভাঙন রোধে বিভিন্ন পয়েন্টে কাজ করা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুম শেষে ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী প্রতিরক্ষার কাজ করা হবে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। বাঁধ, উঁচু স্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থিত পরিবারগুলো এখন তাদের নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে।
শরীয়তপুরে পদ্মার পানি বিপদসীমার উপরে
শরীয়তপুর সংবাদদাতা জানান, গত তিন দিন ধরে পদ্মার পানি আবারো বাড়তে শুরু করায় জেলার জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলসহ আরো নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে চার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় জোয়ারের সময় পদ্মার পানি সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আগে থেকেই পানিবন্দী থাকা মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। দুর্গত এলাকায় আবারো দেখা দিয়েছে খাদ্য, স্যানিটেশন-ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সঙ্কট। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণতৎপরতা অব্যাহত থাকলেও প্রয়োজনের চেয়ে তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বন্যাকবলিতরা। জাজিরার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, আমরা দ্বিতীয় দফায় ২৪০ মেট্রিক টন চাল, চার লাখ টাকা, এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫০০ প্যাকেট শিশুখাদ্য ও এক হাজার ১২৫ প্যাকেট গো-খাদ্য বরাদ্দ পেয়েছি।
লক্ষ্মীপুরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : ফেরী চলাচল বন্ধ
লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা জানান, উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যার পানির চাপ ও মেঘনার জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন প্লøাবিত হয়েছে। পাশাপাশি পানির চাপে বুধবার বিকেলে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মজুচৌধুরীরহাট ফেরিঘাটের সড়ক ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌ-রুটের ফেরি চলাচল। অস্বাভাবিক জোয়ারে মেঘনা নদীর পানি বেড়ে দুর্ভোগে পড়েছেন চার উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। স্থানীয়রা জানায়, মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ার ও বন্যার পানির চাপে হঠাৎ করে ১৬টি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হওয়া ইউনিয়নগুলো হচ্ছে রামগতির বড়খেরী, চরআলগী, চররমিজ, চরআবদুল্লাহ, চরআলেকজান্ডার, কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট, পাটওয়ারীরহাট, চরকালকিনি, চরফলকন, চরলরেন্স, চরমার্টিন, সদর উপজেলার চরমনীমোহন ও রায়পুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। এ ছাড়া ফেরিঘাটের সড়ক নদীতে বিলীন হওয়ায় ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে দু-পাড়ে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে কয়েশ পণ্য ও যাত্রাবাহী বাস-ট্রাক। এ ছাড়া সড়ক ভেঙে যাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য মজুচৌধুরীরহাট ঘাটের ফেরি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ সড়ক ঠিক করা হবে, সেটি অনিশ্চিত করে জানাতে পারেনি সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুর রিদোয়ান আরমান শাকিল।
মির্জাগঞ্জে নদীর পানি বৃৃদ্ধি
মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, মির্জাগঞ্জে পূর্ণিমার প্রভাব ও জোয়ারে পায়রা ও শ্রীমন্ত নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পেলে সুবিদখালী বাজারসহ পিঁপড়াখালী গ্রামটি পানিতে প্লøাবিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত এ জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়। এ দিকে গতকাল সকাল থেকে আকাশ মেঘাছন্ন ও থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নদীতে জোয়ারের পানি ৪-৫ ফুট উঁচুতে প্রবাহিত হচ্ছে। তলিয়ে গেছে পায়রাকুঞ্জ ফেরিঘাটের পন্টুনের গ্যাংওয়ে। এতে ভোগান্তিতে পড়ে হাজারও যাত্রী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফেরীতে উঠতে হচ্ছে নৌকায় করে। আবার এতে তাদেরকে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। পিঁপড়াখালী বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসরত ১৫টি পরিবার প্রতিদিন দু’বার করে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। পায়রা নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীবেষ্টিত মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নের সুন্দ্রা কালিকাপুর, ভিকাখালী, রামপুর, পিঁপড়াখালী, কপালভেড়া এবং দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়নের গোলখালী, মেহেন্দীয়াবাদ, চরখালী, রানীপুর, কাঁকড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ভয়াং ও কাঁকড়াবুনিয়া গ্রামের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে আছে।
হাতিয়ায় ১৫ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী
নোয়াখালী সংবাদদাতা জানান, পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ১৫টি গ্রাম প্লøাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়েছে গ্রামবাসী। এতে প্রায় ২০ সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বুধবার দুপুরে জোয়ারের পানি বাড়তে থাকায় এসব এলাকা প্লাবিত হয়। এতে উপজেলার নলচিরা, সুখচর, চরঈশ্বর, তমরদ্দি, সোনাদিয়া, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের নলেরচর ও বয়ারচরের নিম্নাঞ্চলের বসতঘরসহ আশপাশের এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আমফানের প্রভাবে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় এসব এলাকা অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে সহজে প্লাবিত হয়। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: রেজাউল করিম জানান, বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি
১৩ জেলার পরিস্থিতির উন্নতি
বাসস জানায়, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, চাঁদপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরিয়তপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, অপরদিকে পদ্মা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মনু নদী ছাড়া উত্তরাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। রাজধানী ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা সিটি করপোরেশন সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলেরর বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।
দেশের ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১৮টি।
এর মধ্যে বৃদ্ধি ৩৪টি এবং হ্রাস ৬৩টির, বিপদসীমার উপরে নদ-নদীর সংখ্যা ১৪টি এবং অপরিবর্তিত ৪টি, আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১৩টি, বিপদসীমার উপর স্টেশনের সংখ্যা ২০টি, বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত স্টেশন ২২টি। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে, পটুয়াখালী ৬৬ মিলিমিটার, মৌলভীবাজার ৫১ মিলিমিটার ও বরগুনায় ৫৫ মিলিমিটার।


আরো সংবাদ



premium cement