২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`
কক্সবাজারে সেনা ও পুলিশ প্রধানের সংবাদ সম্মেলন

সিনহা হত্যায় বোনের মামলা

মামলা দায়েরের পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন মেজর (অব:) রাশেদের বোন। ইনসেটে প্রধান আসামি এসআই লিয়াকত ও ওসি প্রদীপ : নয়া দিগন্ত -

টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের ঘটনায় তৈরি হওয়া শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চলছে নানা প্রচেষ্টা। গঠিত তদন্ত দলের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে, সেই দিনের বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেছেন কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া সেনাবাহিনী প্রধান এবং পুলিশ প্রধান গতকাল বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এর আগে তারা কক্সবাজার শহরে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মেজর (অব:) সিনহার ঘটনায় যারা দোষী হবেন তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। এ দিকে ইয়াবা পাচার রোধ এবং সব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিহত করতে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে চেকপোস্ট পরিচালনার দায়িত্ব পুরোপুরি সেনাবাহিনীর কাছে ন্যস্ত করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। তারা বলেছেন, মেরিন ড্রাইভ রোডে একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনায় পর্যটকসহ সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। এতে দেশের পর্যটন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ওসিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা : সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে কক্সবাজারে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে (টেকনাফ নম্বর-৩) হত্যা মামলাটি দায়ের করেছেন নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে এটিকে এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করতে টেকনাফ থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মামলাটি তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি আদালতকে জানাতে কক্সবাজারস্থ র্যাব-১৫ ক্যাম্পের অধিনায়ককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এজাহারে প্রধান আসামি করা হয়েছে শাপলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (প্রত্যাহারকৃত) ও এসআই লিয়াকত আলীকে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১, ৩৪ ধারায় দায়ের করা এই মামলায় টেকনাফ থানার আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। মামলার অপর সাত আসামি হলেন থানার এসআই দুলাল রক্ষিত,কনস্টেবল সাফানুর করিম,কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। তবে আসামির তালিকায় পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনের নাম নেই। মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে নিহত সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। তার বাড়ি বরগুনার পূর্ব শফিপুর গ্রামে। মামলা দায়েরের সময় আইনজীবীর পাশে ছিলেন বাদি শারমিন শাহরিয়াসহ নিহতের পরিবারের অন্য সদস্যরা। তাদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা থেকে আসা হাইকোর্টের আইনজীবী আনোয়ারুল কবিরও।
এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ৩১ জুলাই বিকেলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্ট থেকে তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণের জন্য টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়ে যান। এ সময় সিনহার পরনে ছিল কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট। তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণ করার উদ্দেশ্যেই এই পোশাক তিনি পরেছিলেন। রাত ৮টা পর্যন্ত পাহাড়ে ছিলেন সিনহা ও সিফাত। তারা পাহাড়ে দিনের ও সন্ধ্যাকালের দৃশ্য ধারণ করেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে নিজস্ব প্রাইভেটকারে শাপলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পৌঁছলে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ আসামিরা গাড়িটির গতিরোধ করেন। এ সময় সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তখন আসামিরা সিফাতকে গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যান। এ সময় সিফাত দুই হাত উপরে তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন। এতে আসামিরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা চালকের আসনে বসে থাকা সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। এ পর্যায়ে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত উপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দিতে থাকেন। কিন্তু সিনহাকে উদ্দেশ করে আরো গালমন্দ শুরু করেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। তিনি বলতে থাকেন,‘তোর মতো বহুত মেজরকে আমি দেখছি,এইবার খেলা দেখামু।’ এরপর লিয়াকত আলী টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দিয়ে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। একপর্যায়ে লিয়াকত আলী ফোনে ওসি প্রদীপকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি।’ এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই লিয়াকত আলী সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে মেজর (অব:) সিনহার শরীরে কয়েকটি গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান। নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাকে চেপে ধরে পুনরায় মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরো একটি গুলি করেন লিয়াকত আলী। পরে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এ ছাড়া নিজের বুট দিয়ে ঘষা মেরে সিনহার মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় মামলার সাক্ষী ও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে আসামিরা অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন। রাত ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলা দায়ের করে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, ‘আমার ভাই দেশের একজন বীর সন্তান। তাকে যেভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিচার চাইতে আমি কক্সবাজার এসেছি। আমি মামলা করেছি এবং বলেছি মামলাটি যেন তদন্তের জন্য র্যাবকে দেয়া হয়। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন।’
সেনা ও পুলিশ প্রধানের যৌথ সংবাদ সম্মেলন : এদিকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় যারা দোষী হবেন তাদের শাস্তি পেতে হবে। ঘটনাটি তদন্তাধীন আছে, তাই এটি নিয়ে কোনো কথা বলব না। তারা এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনী এবং পুলিশের মধ্যে সম্পর্কে চিড় বা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে এমন প্রয়াস না চালানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। গতকাল কক্সবাজারের সি বিচ সংলগ্ন সেনাবাহিনীর বাংলো জলতরঙ্গে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে উভয়ে দৃঢ় আস্থার সাথে বলেন, সিনহা নিহতের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এতে দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরবে না। জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘সেনাবাহিনী ও পুলিশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। যে ঘটনা ঘটেছে, অবশ্যই সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী মর্মাহত। এটিকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মেজর (অব:) সিনহার মাকে ফোন করে সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। তার কথার ওপর সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর আস্থা আছে। যে যৌথ তদন্ত দল গঠিত রয়েছে, তার ওপরও দুটি বাহিনীই আস্থাশীল।
জেনারেল আজিজ বলেন, ‘আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরে এমন কিছু হবে না।’ পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ বলেন, এ ঘটনা নিয়ে অনেকে উসকানিমূলক কথা বলার চেষ্টা করছেন। যারা উসকানি দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।’ সেনাবাহিনীর সঙ্গে পুলিশের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক সুদীর্ঘ সময়ের। তাই মেজর (অব:) সিনহার ঘটনায় এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হবে না। তদন্ত কমিটি প্রভাবমুক্ত পরিবেশে তদন্ত করবে। কমিটি যে সুপারিশ দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


আরো সংবাদ



premium cement