১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অপ্রতুল করোনা টেস্টই মহামারী মোকাবেলায় প্রধান বাধা

-

দেশে অপ্রতুল করোনা টেস্টই মহামারী মোকাবেলায় প্রধান অন্তরায় বলে মনে করে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডা: খোন্দকার মেহেদী আকরাম। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও দৈনিক সাড়ে ছয় লাখ টেস্ট করছে। বাংলাদেশও জনবহুল দেশ। সফলতার সাথে করোনা মোকাবেলা করতে হলে দৈনিক করোনা টেস্ট এখনকার চেয়ে ১০ গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম করোনা মোকাবেলার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, করোনা পরীক্ষার কথা বললে ইদানীং আমাদের ভেতরে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকেই করোনা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে ছোট করে দেখছেন। অনেকে বলছেন, ‘করোনা পরীক্ষা করে লাভ কী? করোনা টেস্ট করে তো আর এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না!’
তিনি বলেন, প্রায় পাঁচ মাস হলো বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ২৬৭ জন। ১৬ কোটির এই দেশে পাঁচ মাসে মৃতের এই সংখ্যা হয়তো তেমন একটা বেশি না। করোনায় পৃথিবীতে গড় মৃত্যুহার যেখানে ৪ শতাংশ, সেখানে আমাদের দেশে কোনো এক অলৌকিক কারণে মৃত্যুহার মাত্র ১.৩ শতাংশ। আর সম্ভবত এ কারণেই আমরা ভুলতে বসেছি যে, আমরা আসলে এখন করোনা মহামারীর পিক সময়টাতে অবস্থান করছি অথবা পিকের দিকে ধাবিত হচ্ছি। তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া মহামারীতে গোটা বিশ্বে করোনায় প্রাণ গেছে সাত লাখেরও বেশি মানুষের। ইউরোপ আমেরিকার কথা না হয় বাদই দিলাম। ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত দিক দিয়ে ওসব দেশ আমাদের থেকে আলাদা। ওই সব দেশের মানুষও আমাদের থেকে আলাদা। অনেকে বলে থাকেন, করোনা পাশ্চাত্যের লোকদের যেভাবে আক্রান্ত করেছে, আমাদের সেভাবে করবে না। তাদের ধারণা দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের মতো চামড়ার মানুষেরা করোনার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিরোধী ক্ষমতা রাখে।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে এটা এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, করোনা মহামারীর এপিসেন্টার (কেন্দ্র) এখন দক্ষিণ এশিয়ায়। আর এই এপিসেন্টারের প্রধান কেন্দ্র হলো আমাদের পড়শি দেশ ভারত। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ভারতে করোনায় প্রাণ গেছে ৪০ হাজার, আর আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২০ লাখ। প্রতিদিন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার। বলা যায়, মহামারীর তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে দেশটিতে। ভারতে করোনায় মৃত্যুহার মাত্র ২ শতাংশ। অপেক্ষাকৃত কম মৃত্যুহারের অজুহাতে ভারত কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। তারাও সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে করোনা দমনে। কারণ তারা ভালো করেই জানে যে, ১৩৮ কোটি লোকের দেশে ২ শতাংশ মৃত্যু হলে মোট মৃতের সংখ্যাটি হবে অনেক বড়।
৩১ জুলাইয়ের উপাত্ত অনুযায়ী দেখা যায়, বর্তমান সময়ে প্রতিদিন করোনা টেস্টের দিক দিয়ে বিশ্বে ভারত রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে সবার ওপরে। ওই দিন ভারত মোট পরীক্ষা করেছে ৬ লাখ ৪০ হাজার এবং যুক্তরাষ্ট্র করেছে ৭ লাখ। আর বাংলাদেশ? তারা ওই দিন টেস্ট করেছে মাত্র ১২ হাজার ৯০০! ভারত ক্রমান্বয়ে তাদের টেস্ট করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। মে মাসে তারা গড়ে প্রতিদিন টেস্ট করেছে এক লাখের ওপরে। জুনে এই সংখ্যা ছিল দুই লাখ। জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত তারা গড়ে প্রতিদিন টেস্ট করেছে ৪ লাখ। আর বাংলাদেশে গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার। এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের টেস্ট করার সক্ষমতা এক চুলও বাড়েনি। কেন? টেস্টের কি তাহলে কোনো প্রয়োজন নেই ? আর যদি টেস্টের প্রয়োজনীয়তা না-ই থাকে তাহলে এত পয়সা খরচ করে ভারত কেন প্রতিদিন লাখ লাখ টেস্ট করে?
প্রকৃত পক্ষে করোনার মতো ভয়াবহ মহামারী মোকাবেলায় টেস্টিং ও ট্রেসিংই সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি মনে করেন ড. মেহেদী আকরাম। তিনি যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন, এই বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। শুধু চিকিৎসা দিয়ে করোনা মোকাবেলা সম্ভব নয়। মোকাবেলার জন্য দরকার ইনফেকশন কন্ট্রোল (জীবাণু নিয়ন্ত্রণ)। সংক্রমণ প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকরী পন্থা। আর এই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দরকার সংক্রমণ শনাক্তকরণ। পর্যাপ্ত টেস্টের মাধ্যমেই শুধু এটা করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত ও পরিকল্পিত টেস্টের মাধ্যমে জানা যায়, একটা দেশে সংক্রমণ কোন গতিতে এগোচ্ছে, দেশটির কোন অঞ্চল কেমন আক্রান্ত, আক্রান্তের হার, ডাব্লিং টাইম ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে রোগ বিস্তারের সম্ভাব্য প্রকৃতি, টেস্টিং ও ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন এবং সম্ভাব্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ও টিকার প্রয়োজনীয়তা।’
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, এই পাঁচটি বিষয়ে সম্যক ধারণা ছাড়া কখনোই সুষ্ঠুভাবে একটি মহামারী মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আর এই কারণেই ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশ করোনা টেস্টের দিকে এতটা নজর দিচ্ছে। পর্যাপ্ত টেস্ট ছাড়া করোনা মোকাবেলা করা আর চোখ বন্ধ করে ব্যস্ত মহাসড়কে হাঁটা অনেকটা একই রকম ঝুঁকিপূর্ণ! গত ৩ আগস্ট স্বাস্থ্য বুলেটিনে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে ১০০টি টেস্টের মধ্যে ৩২টি পজিটিভ এসেছে! এখন একবার ভাবুন, যদি আমরা ওই দিন এক লাখ টেস্ট করতাম, কতজন নতুন রোগী শনাক্ত করতে পারতাম? বাংলাদেশে এখন দরকার প্রতিদিন টেস্টের সংখ্যা অন্তত ১০ গুণ বাড়ানো। ভারত যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারব না?


আরো সংবাদ



premium cement