২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি

প্রতারণার অভিযোগ স্বীকার সাহেদের

১০ দিনের রিমান্ড কাঠগড়ায় কান্না
রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদকে গতকাল সিএমএম আদালতে হাজির করা হচ্ছে : নয়া দিগন্ত -

করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন গ্রেফতারকৃত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ। ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অসহায় মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গোয়েন্দা পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার অভিযোগ স্বীকার করেন তিনি। এ ছাড়া হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের আগে কিছু যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলেছেন বলেও জানান। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিবি কার্যালয় গেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সাহেদ অনেক কিছুই বলেছেন ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে। তবে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পালিয়ে থাকার ব্যাপারেও কথা বলেছেন। টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়েও কথা বলেছেন তিনি।
এ দিকে সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। একই মামলায় সাহেদের অন্যতম দুই সহযোগী মাসুদ পারভেজ ও তারেক শিবলীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আবদুল বাতেন বলেন, প্রতি দিনই নতুন নতুন মামলার তথ্য আসছে। অনেক মামলা। সব মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা এবং সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাত্র রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে সব তথ্য বের হয়ে আসবে।
পুলিশ কর্মকর্তা জানান, র্যাবের অভিযানের আগে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা থেকে যন্ত্রপাতিসহ বেশ কিছু সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সাহেদ। ডিবির অভিযানে এসব যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হবে।
ডিবি সূত্র জানিয়েছে, করোনাকালীন দুই মাসে অন্তত চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রতারক সাহেদ। হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বাকিতে পণ্য এনে বিক্রি করে টাকা পকেটে ভরেছেন। কারো টাকা পরিশোধ করেননি। তার বিরুদ্ধে আরো যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলোও একে একে তিনি স্বীকার করছেন। রিমান্ডে সাহেদ ও মাসুদকে আলাদা আলাদা এবং মুখোমুখি করেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর আগে বুধবার ভোরে সাহেদকে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতারের পর বিকেলে র্যাব তাকে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। বুধবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি পুলিশ।
সাহেদ ১০ দিনের রিমান্ডে : করোনা পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাহেদকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। একই মামলায় তার দুই সহযোগীরও রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মাসুদ পারভেজকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। সাহেদের আরেক সহযোগী ও রিজেন্ট হাসপাতালের কর্মী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আবার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম শুনানি শেষে রিমান্ডের এই আদেশ দেন।
এর আগে সাহেদ, মাসুদ পারভেজ ও তারেক শিবলীকে আদালতে হাজির করে তাদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন ডিবির পুলিশ পরিদর্শক গাফফারুল আলম। তিনি উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের হওয়া প্রতারণা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে আদালত রিমান্ডের আদেশ দেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাহেদকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেয়া হয়। সাহেদের পাশাপাশি আদালতে তোলা হয় মাসুদ পারভেজকে। তাকে আদালতে তুলে ১০ দিন রিমান্ড চাওয়া হয়। রিজেন্টের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় যে মামলা হয়েছে ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় গাজীপুরের কাপাসিয়ার একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
একই মামলার আরেক আসামি ও সাহেদের সহযোগী তারেক শিবলীকে আবার সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। পাঁচ দিন রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। তাকে ১০ দিনের জন্য রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হয়। পরে আদালত তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
কাঠগড়ায় সাহেদের কান্না, আমি নিজেও করোনা রোগী : আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাহেদ বললেন, ‘আমি নিজেও করোনা রোগী’। আমার বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। একমাত্র আমিই বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দেই। আমি এই ঘটনার সাথে জড়িত নই। ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তোলা হলে রিমান্ড শুনানির মাঝখানে বিচারককে তিনি এসব কথা বলেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষে বিচারক সাহেদকে জিজ্ঞেস করেন তার কিছু বলার আছে কি না। তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাহেদ নিজেকে করোনা রোগী দাবি করে এসব কথা বলেন।
সাহেদের কাছে মানুষের জীবন বা মৃত্যুর কোনো মূল্য নেই : সাহেদ নিজেকে সুধী ও ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে সে একজন ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু ও পাষণ্ড প্রকৃতির লোক। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বেলায় তার কাছে মানুষের জীবন বা মৃত্যুর কোনো মূল্য নেই। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক এস এম গাফ্ফারুল আলম আসামির রিমান্ড আবেদনে এসব কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সাহেদ তার দোসরদের সহযোগিতায় কোভিড-১৯ পরীক্ষার রিপোর্ট ও চিকিৎসা উভয় ক্ষেত্রেই প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কোনো রোগী প্রতারণার কথা বুঝে তার প্রতিবাদ করতে চাইলে তাকে হুমকি-ধমকি দিত সে। ফলে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতো না। কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফরমে বিনামূল্যে লেখা থাকলেও পরীক্ষা বাবদ ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা নেয়া হতো।
সাহেদের বিরুদ্ধে জাল টাকার মামলা : সাহেদের গোপন অফিস থেকে জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করেছে র্যাব। গতকাল দুপুরে এই মামলা করা হয়। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় র্যাবের একজন এসআই মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাহেদকে। এ ছাড়া মাসুদ পারভেজসহ অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে।
সাহেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা : প্রতারক সাহেদসহ তিনজনকে আসামি করে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দেবহাটা থানায় অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করেছে র্যাব। গত বুধবার ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা থেকে সাহেদকে গ্রেফতারের পর রাতেই র্যাব-৬ এর সিপিসি-১ এর ডিএডি নজরুল ইসলাম বাদি হয়ে ১৯৭৮ সালের আর্মস অ্যাক্টের ১৯ এ তৎসহ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ এর বি/এ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় সাহেদকে প্রধান আসামিসহ নৌকার মাঝি বাচ্চুকে পলাতক আসামি এবং আরো একজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। দেবহাটা থানার ওসি বিপ্লব কুমার সাহা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, র্যাবের পক্ষ থেকে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
প্রতারণাসহ নানা অপকর্মের ঘটনায় ইতঃপূর্বে প্রতারক সাহেদের বিরুদ্ধে ৫৯টি মামলার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যার মধ্যে একাধিক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি ছিলেন সাহেদ। সর্বশেষ করোনাভাইরাসের ভুয়া টেস্ট ও জাল সনদ প্রদানের ঘটনায় র্যাবের অভিযানে রিজেন্ট হাসপাতালের দু’টি শাখা সিলগালা ও মামলা দায়ের হলে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন সাহেদ।
প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। পরীক্ষা ছাড়াই করোনার সনদ দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা ও অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আসছিল তারা। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অন্তত ছয় হাজার ভুয়া করোনা পরীক্ষার সনদ পাওয়ার প্রমাণ পায়। একদিন পর গত ৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে র্যাব রিজেন্ট হাসপাতাল ও তার মূল কার্যালয় সিলগালা করে দেয়। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ওই দিনই উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement