১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

৭ ব্যাংকের ঋণের চেয়ে আমানতের সুদ হার বেশি

ঋণ আমানতের সুদ হারে অস্বাভাবিক পতন
-

ঋণ আমানতের মুনাফার হারে অস্বাভাবিক পতন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ৭ ব্যাংকের ঋণের চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি উঠে গেছে। ঋণ আমানতের সুদহারের এ পার্থক্যে (সুদহারের ব্যাপ্তি) ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে ৫৯টি ব্যাংক ও ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। এ কারণে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। একে তো করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংক লেনদেন কমে গেছে, এরওপর সুদহারের প্রভাব সবমিলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার উপক্রম হয়েছে।
ঋণ আমানতের সুদহারের ব্যবধানের এ অস্বাভাবিক পতনের ব্যাপারে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অর্থনীতির আকার অনুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। এ কারণে আমানত সংগ্রহে এক ধরনের অশুভ প্রতিযোগিতা আছে। একই আমানত নিয়ে একাধিক ব্যাংক কাড়াকাড়ি করছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী রাতারাতি ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাধ্য হলেও আমানতের সুদহার ওই হারে কমানো যায়নি। আর এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও আমানতের সুদহার অভিন্ন করার ওপরে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। শুধু ঋণের সুদহারের বিষয়ে ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ কারণে তহবিল সঙ্কটে রয়েছে এমন কিছু ব্যাংক আমানত হারানোর ভয়ে রাতারাতি আমানতের সুদহার কমাতে পারেনি। এর ফলেই ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার উপক্রম হয়েছে।
ঋণ আমানতের সুদহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত মে মাসে ঋণ আমানতের সুদহারের গড় ব্যবধান ২ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে গেছে। এ সময়ে আমানতের গড় সুদহার কমে নেমেছে ৫ দশকি ২৪ শতাংশে, বিপরীতে ঋণের গড় সুদহার নেমেছে ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে। তবে, বিদেশী ৯ ব্যাংকের সুদহার বাদ দিলে প্রকৃতপক্ষে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গড় সুদহারের ব্যবধান আরো কমে যাবে। কারণ, বিদেশী ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার ২ শতাংশের চেয়ে একটু বেশি। কিন্তু ঋণের গড় সুদহার পৌনে ৮ শতাংশ। এর মধ্যে বেশির ভাগ বিদেশী ব্যাংকেরই ঋণ আমানতের সুদহারের ব্যবধান ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এ কারণে বিদেশী ব্যাংক বাদ দিলে সুদের ব্যাপ্তি আরো কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৭ ব্যাংকের আমানতের চেয়ে ঋণের সুদহার কমে গেছে। আর ২২টি ব্যাংকের সুদের ব্যাপ্তি ২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
আমানতের চেয়ে ঋণের সুদহার বেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের মে মাসে আমানতের গড় সুদহার ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, যেখানে ঋণের গড় সুদহার ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। এতে মাস শেষে সুদের ব্যাপ্তি হয়েছে ঋণাত্মক ১ দশকি ৮৯ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংকের (বিডিবিএল) আমানতের গড় সুদহার ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, যেখানে ঋণের গড় সুদহার ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ আলোচ্য মাসে সুদের ব্যাপ্তি ছিল শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ দিকে বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের মধ্যে দুই ব্যাংকেরই ঋণের চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি রয়েছে মে মাসে। এর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের যেখানে আমানতের গড় সুদহার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে ঋণের গড় সুদহার ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ সুদের ব্যাপ্তি হয়েছে ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। তেমনিভাবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণের সুদহারের চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি হয়েছে মে মাসে। ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ, সেখানে ঋণের গড় সুদহার ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। তেমনিভাবে বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার ব্যাপ্তি হয়েছে ঋণাত্মক ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ব্যাংকটির মে মাসে আমানতের গড় মুনাফার হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে গড় ঋণের মুনাফার হার ছিল ১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
বিদেশী ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৬টিরই সুদের ব্যাপ্তি ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। তবে, হাবিব ব্যাংকের গড় সুদহারের ব্যবধান ৪ দশমিক ২ শতাংশ, ব্যাংক আলফালাহ সাড়ে ৪ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের গড় সুদহারের ব্যবধান ঋণাত্মক ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সিটি ব্যাংক এনএ ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ, উরি ব্যাংকের ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং এইচএসবিসির ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
অপর দিকে সুদহারের ব্যবধানের মধ্যে স্থানীয় ৪১টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ১৮টিরই ২ শতাংশের নিচে রয়েছে যা, দেশী বিদেশী মিলে ২২টি।
ব্যাংকাররা জানিযেছেন, করোনার প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দায় ব্যাংক লেনদেন কমে গেছে। মে মাসে প্রায় ৩৫ শতাংশ আমদানি ব্যয় কমে গেছে। রফতানিতেও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এর সাথে রয়েছে ঋণের সুদহার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাতারাতি আমানতের সুদহার কমানো যায়নি। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ের ওপর প্রভাব পড়েছে। গত জুন শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই মুনাফা কমে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সামনে মূলধনে হাত দিতে হবে অনেক ব্যাংকেরই। কারণ, ৬ শতাংশে আমানত বেশির ভাগ ব্যাংকই নামিয়ে এনেছে গত জুন মাসে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাংক আমানত আকৃষ্ট করতে এখনো বেশি হারে সুদ দিচ্ছে। এতেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটা কাটানোর জন্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঋণ আমানতে উভয়ের ক্ষেত্রেই বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে হবে, না হয় ঋণের মতো আমানতেরও সুদহার বেঁধে দিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের অসম প্রতিযোগিতা কাটবে বলে তারা মনে করছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement