২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারী বর্ষণে আবার বন্যা

সুরমা ও তিস্তা বিপদসীমার উপরে; পাহাড়ি ঢলে পরিস্থিতির অবনতি; লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী; বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
সুনামগঞ্জে চার দিকে থই থই বানের পানি। কলা গাছের ভেলায় প্রয়োজনীয় কাজ সেরে কিশোরীটি ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে : নয়া দিগন্ত -

সুনামগঞ্জ, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে নতুন করে আবার বন্যা দেখা দিয়েছে। ভারীবর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলের পানি আসা অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুরমান ও তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এতে বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সুনামগঞ্জে ফের বন্যা
সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, ১৫ দিনের ব্যাবধানে সুনামগঞ্জে ফের বন্যায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় সব ক’টি উপজেলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শনিবার সকাল ৯ টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শহরের ষোলঘর পয়েন্টস্থ সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই সময়ে ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ছাতক, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের রাস্তাটি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জ শহরের কাজির পয়েন্ট, উকিলপাড়া, নতুনপাড়া, বড়পাড়া সাহেববাড়ি ঘাট, ষোলঘর হাজীপাড়া, জামতলাসহ অধিকাংশ এলাকার বাসাবাড়ি রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ায় রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল নেই বলইে চলে। ফলে মানুষজন চরম বিপাকে পড়ে খাদ্য সঙ্কটে ভুগছেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, উপজেলা সদরের আকল্পাশ ও হাওর এলাকার বিভিন্ন গ্রামে বন্যায় কোথাও বুক পানি, কোথাও কোমর সমান পানি হয়েছে। জামালগঞ্জে-সেলিমগঞ্জ সড়ক দিয়ে নদীর পানি উপচে পড়ে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। জেলার হাওর পাড়ের গ্রামীণ জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে।
এ দিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায়, জেলা শহরের সাথে জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিপুর, দিরাই-শাল্লার একমাত্র সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, যেভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে তাতে বন্যার আশঙ্কা থেকে জেলার প্রতিটি উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যায় কত হাজার পরিবার ঘরবন্দী হয়েছেন তাদের সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা না গেলেও প্রায় লাখ মানুষ পানিবন্দী হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ দিকে জেলায় রোপা আমন, সবজি ক্ষেত ও পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়। জেলা প্রশাসন জেলায় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষজনের জন্য খাদ্যসহায়তা হিসেবে জিআর ৪০০ মেট্রিক টন চাল ও ৮ লাখ টাকা, শিশু খাদ্য বাবদ ৩ লাখ, গবাদি পগু খাদ্য বাবদ ২ লাখ টাকা এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এ দিকে জামালগঞ্জ সরকারি কলেজে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তদের জামালগঞ্জ বহুমুখী জনকল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সাবেক উপজেলা ভাই চেয়ারম্যন মু: রশিদ আহমদ ও হাফেজ আব্দুল গাফফার ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেছেন।
ধর্মপাশায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী
ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ঢলের পানি সুরমা নদী দিয়ে প্রবেশ করায় সীমায় প্রবাহিত হয়ে উপজেলার সর্বত্র লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এলজিইডির ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তাসহ সব সড়ক বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগে ও কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে বন্যা কবলিত এলাকায় মনিটরিং ও বন্যা দুর্গত পরিবারকে নিরাপদ স্থানে আনা অব্যাহত রয়েছে।
তিস্তার ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি চতুর্থ দফায় আবার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া-তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় তিস্তার চরবেষ্টিত গ্রামগুলোর প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, শুক্রবার রাত থেকে তিস্তার পানি বাড়তে থাকে, যা শনিবার সকাল ৬টায় ৫২ দশমিক ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে (বিপদসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার)। পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি সøুইস গেট খুলে রাখা হয়েছে।
এ দিকে কিছামত ছাতনাই, ঝাড়সিঙ্গেশ্বর, চড়খড়িবাড়ী, পূর্ব খড়িবাড়ী, পশ্চিম খড়িবাড়ী, তিস্তা বাজার, বাইশপুকুর, ছাতুনামা, ভেণ্ডাবাড়ি এলাকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সেখানকার মানুষ ও গবাদিপশুকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতীফ জানান, ভারতের গজলডোবা থেকে হু হু করে পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এতে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কুড়িগ্রামে আবার পানি বৃদ্ধি
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে চার দিন থেকে অবিরাম বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় দফায় উজানের পাহাড়ি ঢলে আবার নিম্নœাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।
কুড়িগ্রাম আবহাওয়া অধিদফতরের ইনচার্জ সুবল চন্দ্র সরকার জানান, গতকাল শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসডি মাহমুদ হাসান জানান, গত বুধবার রাত থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত দিনরাত থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির ফলে জেলার সব ক’টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
রংপুরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন
রংপুর অফিস জানায়, তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রংপুরের তিনটি উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও প্রটেকশন ওয়ালের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেয়া দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিস্তা পারের মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মেহেদী হোসেন জানান, তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে ওঠানামা করছে। গতকাল শনিবার বেলা ৩টায় ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানি ২৭ সেন্টিমিটার ওপরে থাকলেও সন্ধা ৬টায় তা বেড়ে ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, সদর, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্নেয়া, কাউনিয়া উপজেলার শহিদবাগ, বালাপাড়া, টেপামধুপুর, পীরগাছার তাম্বুলপুর এবং ছাওলা ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের হাজার হাজার বসতি বাড়িতে পানি উঠেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত ২৫ হাজার মানুষ। গঙ্গাচড়ার আলমবিদিতর ইউনিয়নের গাটুপাড়া এলাকায় ৫০ মিটার এবং ভুদভুদিপাড়ায় ২০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন দ্রুতগতিতে মেরামত করা না হলে ভাঙনে তলিয়ে যাবে পাশের লতির দোলা, হাজীপাড়াসহ আশপাশের সরাই বাড়ি বাজার কয়েকটি স্কুল মসজিদ ও মাদরাসা বিস্তীর্ণ এলাকা। হুমকির মুখে পড়বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডান তীর রক্ষা বাঁধ। যদি মূল বাঁধটি ভেঙে যায় তাহলে তিস্তা গিয়ে পড়বে ঘাঘটে। এতে পানি ঢুকে পড়বে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। তাই জরুরি ভিত্তিতে ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করার দাবি তাদের।
এ ছাড়াও নোহালী ইউনিয়নের আলসিয়া পাড়ায় তিস্তা ডান তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঘুটামারি এলাকারটি বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। পানি উন্নযন বোর্ড জিওব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষা করার চেষ্টা করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, পানি বাড়ায় রংপুরের তিনটি উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের আংশিক এলাকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন ধরেছে। সেসব এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধ করা হচ্ছে।
দশ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে
বাসস জানায়, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইকবান্ধা, জামালপুর, নাটোর, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
অপর দিকে ব্রহ্মপুত্রÑযমুনা,গঙ্গা এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদ, নুন খাওয়া ও চিলমারী পয়েন্টে যমুনা নদী, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি ও কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। এবং বিপদসীমার উপর দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। অপর দিকে ধরলা নদীর পানি সমতলবৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আপার মেঘনা অববাহিকার সুরমা নদী সিলেট পয়েন্টে পুরাতন সুরমা নদীর দিরাই পয়েন্টে এবং সোমেশ্বরী নদী, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। দেশের ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৬টির, হ্রাস পেয়েছে, ৩৩টির, অপরিবর্তিত রয়েছে দু’টি এবং বিপদসীমার উপরে রয়েছে সাতটির।
সারা দেশে বৃষ্টির গড় ২৫২ মিলিমিটার, মহেশখোলা ২২৩ মিলিমিটার, দুর্গাপুর ১৮২ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জ ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement