২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গ্লোবের ভ্যাক্সিন আগামী জুনের আগে না

-

আগামী ডিসেম্বরেই গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাক্সিন বাজারে নিয়ে আসার ঘোষণা দেয়ায় দ্বিমত পোষণ করছেন ভ্যাক্সিন বিশেষজ্ঞরা। বায়োমেডিক্যাল সায়েনটিস্ট ড. খন্দকার মেহেদী আকরাম বলেছেন, এটা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। তিনি বললেন, গ্লোব বায়োটেক এ বছরের মধ্যে ভ্যাক্সিন তৈরির সব ধাপ সম্পন্ন করতে পারবে না। ড. মেহেদী আকরাম মলিকুলার বায়োলজি, ক্লোনিং, ভাইরাল ট্রান্সডাকশন, ভাইরাল রিকম্বিনেশন, অ্যানিমেল মডেলিং, জিন সিকুয়েন্সিংয়ের মতো জটিল বৈজ্ঞানিক কাজের সাথে জড়িত।
তিনি ভ্যাক্সিন তৈরির ধাপগুলো ব্যাখ্যা করে বলেন, গ্লোব বায়োটেক যদি সত্যিই ভ্যাক্সিন তৈরি কাজ করে থাকে তাহলে তারা হয়তো এ পর্যন্ত রূপান্তরিত অ্যাডিনোভাইরাস তৈরির পর্যায়টি সম্পন্ন করেছে। অবশিষ্ট ধাপগুলো কিভাবে সম্পন্ন হবে সে ব্যাপারে ড. খন্দকার মেহেদী আকরাম বললেন, পরের ধাপে ভ্যাক্সিন টার্গেট ভ্যালিডেশন (প্রি-ক্লিনিক্যাল অ্যানিমেল ট্রায়াল) করতে হবে। এ ধাপে প্রিলিমিনারি অ্যানিমেল এক্সপেরিমেন্ট প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপে উৎপাদিত অ্যাডিনোভাইরাস ভ্যাক্সিন ইঁদুর, খরগোশ, বানরের দেহে পুশ করা হয়। এর ১৪ ও ২৮ দিন পর পশুগুলোর রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় পশুর দেহে টার্গেট জিনের বিপরীতে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না। এই পরীক্ষায় যদি দেখা যায় যে, নির্বাচিত চারটি টার্গেটের মধ্যে দুইটির বিপরীতে ইমিউন রেসপন্স করলে এবং সঠিক অ্যান্টিবডি তৈরি হলে ওই দুইটি টার্গেটকে পরের পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়।
গ্লোব বায়োটেকের ব্রিফিং থেকে জানা যায়, তারা এই ধাপটি সম্পন্ন করেছে পাঁচটি খরগোশের ওপর। তারা বলেছে, তাদের ডিজাইন করা চারটি ভ্যাকসিন টার্গেটই খরগোশের দেহে সঠিক অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং এগুলো করোনা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। এ পর্যন্ত আসতে তাদের সময় লেগেছে মোট চার মাস (মার্চ-জুন)। একজন বায়োমেডিক্যাল সায়েনটিস্ট হিসেবে আমাকে বলতেই হবে যে, গ্লোব কাজ করেছে রকেটের গতিতে। কিন্তু কেন তারা প্রিলিমিনারি অ্যানিমেল এক্সপেরিমেন্টে ইঁদুরের পরিবর্তে খরগোশ ব্যবহার করল তার ব্যাখ্যা নেই। খরগোশ এক্সপেরিমেন্টে কি তারা বিএমআরসি থেকে অনুমোদন নিয়েছে? প্রাণী আইন ও লাইসেন্স অনুযায়ী, ইঁদুরকে বাইপাস করে খরগোশে এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলে তার যথাযথ জাস্টিফিকেশন থাকতে হবে। প্রাণী অধিকার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়। গ্লোব বায়োটেকের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এখন তারা ইঁদুরের ওপর ভ্যাক্সিনটির ট্রায়াল দেবে।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, ভ্যাক্সিনের অ্যানিমেল ট্রায়ালে অনেক ধরনের পশু ব্যবহার করা হয়। যেমন, বানর বা ইঁদুর। অক্সফোর্ড ও চীনে ভ্যাক্সিনের প্রি-ক্লিনিক্যাল অ্যানিমেল ট্রায়াল করে বানরের ওপর। অন্য দিকে আমেরিকার মডার্না এমআরএনএ ভ্যাক্সিনের কোনো অ্যানিমেল ট্রায়াল না করেই সরাসরি মানুষের শরীরে পরীক্ষা করেছে। কারণ তাদের ভ্যাক্সিনে কোনো জীবিত বা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করেনি। তবে প্রথাগত ভ্যাক্সিন তৈরিতে অ্যানিমেল ট্রায়াল খুবই জরুরি। যথাযথভাবে সম্পন্ন করা এই ট্রায়ালেই জানা যায়, পশুর শরীরে ভ্যাক্সিন কতটা নিরাপদ এবং কতটা কার্যকরী। ভ্যাক্সিন দ্বারা ইমিউনাইজ্ড পশু কি করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে মুক্ত? ভ্যাক্সিনের ডোজ-ডিপেনডেন্ট রেসপন্সও দেখা হয় এই ট্রায়ালে। এ ধরনের ট্রায়াল সময়সাপেক্ষ।
ড. আসিফ মাহমুদ টিভিতে বলেন, তাদের রয়েছে চারটি টার্গেট এবং তিনটি রুট অর্থাৎ মোট ১২টি কম্বিনেশন। এ ধরনের অ্যানিমেল ট্রায়ালে অনেক ইঁদুরের প্রয়োজন, সময়ও লাগবে অনেক। কেননা দিনের শেষে তাদের দেখাতে হবে যে, তাদের ভ্যাক্সিন (অন্তত দুইটি টার্গেট) ডোজ-ডিপেনডেন্ট ইমিউন রেসপন্স করে। তাদের দেখাতে হবে, তাদের ভ্যাক্সিন পর্যাপ্ত পরিমাণে সঠিক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম এবং ওই অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। শুধু তা-ই নয় তাদের দেখাতে হবে, ভ্যাক্সিন প্রয়োগে ইঁদুরের শরীরে টি-সেল রেসপন্সও হচ্ছে পর্যাপ্ত। এসব ফলাফল যথাযথ কন্ট্রোল এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে দেখাতে পারলেই গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাক্সিনকে মানুষের ওপরে ট্রায়ালের অনুমোদন দেয়া যাবে এবং এটাই নিয়ম। এ ধরনের অ্যানিমেল ট্রায়ালে এথিক্যাল অনুমতি নেয়া থেকে শুরু করে পুরো পরীক্ষা শেষ করতে সাধারণত সময় লাগে তিন-চার মাস। সে হিসাবে গ্লোব বায়োটেকের প্রস্তাবিত ‘কন্ট্রোল্ড অ্যানিমেল ট্রায়াল’ শেষ হতে পারে আগামী অক্টোবর মাস নাগাদ।
তৃতীয় ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ট্রায়াল হচ্ছে ডোজ ও সেইফটি চেক। এই ট্রায়ালে করোনা আক্রান্ত হয়নি এমন কমপক্ষে ৫০-১০০ জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাংসপেশীতে ভ্যাক্সিনটি দেয়া হবে। সাধারণত উচ্চ, মাধ্যম ও নি¤œ (হাই, মিডিয়াম ও লো) এই তিন ডোজে ভ্যাক্সিন দেয়া হয়। এরপর খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে কোনো রিঅ্যাকশন হয় কিনা। ভ্যাক্সিনের কারণে শরীরের সব ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভ্যাক্সিন প্রয়োগের আগে এবং ৭, ১৪ ও ২৮ দিন পরে রক্তের অ্যান্টিবডি টাইটার ও টি-সেল রেসপন্স দেখতে হবে। এসব কিছুর ফলাফল ভালো হলে এবং ভ্যাক্সিনে খারাপ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত না হলে ভ্যাক্সিনটিকে ফেজ টু ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। এথিক্যাল পারমিশন নেয়া থাকলে এবং ভলান্টিয়ার প্রস্তুত থাকলে এ ট্রায়াল দুই মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব। সে বিচারে, গ্লোব বায়োটেক এ বছরের ডিসেম্বরের আগে কোনোভাবেই ভ্যাক্সিনের ফেজ ও ট্রায়াল শেষ করতে পারবে না।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, চতুর্থ ধাপ হচ্ছে হিউম্যান ট্রায়াল। এই ট্রায়ালে প্রমাণ হবে উৎপাদিত ভ্যাক্সিনটি প্রকৃতই করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি করতে পারে কিনা। এ ক্ষেত্রে ৩০০-৫০০ জন বিভিন্ন বয়সের সুস্থ মানুষকে ভ্যাক্সিনটি দিয়ে দুই মাস তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। দেখতে হবে তাদের শরীরে ভ্যাক্সিনটি রোগ প্রতিরোধক তৈরি করতে পেরেছে কিনা। এই ট্রায়ালে প্লাসিবো (ফলস ভ্যাক্সিন দেয়া হবে) কন্ট্রোল গ্রুপও রাখতে হবে তুলনা করার জন্য। সুতরাং সবকিছু ভালোভাবে এগোলে গ্লোব বায়োটেক আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে এই ট্রায়াল শেষ করতে পারবে।
ফেজ থ্রি হিউম্যান ট্রায়ালই শেষ পরীক্ষা এবং সর্ববৃহৎ। এতে বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন গোত্রের ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষকে নিতে হয়। ভ্যাক্সিন দিয়ে তাদের কমিউনিটিতে কোনো প্রকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই চলাফেরা করতে দেয়া হয়। এভাবে অন্তত দুই থেকে তিন মাস পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং দেখা হয় ভ্যাক্সিনগ্রহীতাদের ভেতরে ক’জন করোনায় আক্রান্ত হয় এবং কন্ট্রোল গ্রুপের ক’জন করোনায় আক্রান্ত হয়। যদি দেখা যায় যে, ভ্যাক্সিন দেয়াতে করোনা ইনফেকশন প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে, তখনই কেবল বলা যাবে যে, আবিষ্কৃত ভ্যাক্সিনটি কার্যকরী। অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনটি তিন দেশের প্রায় ২০ হাজার মানুষের ওপর এখন ফেজ থ্রি ট্রায়াল চালাচ্ছে এবং সেপ্টেম্বরে শেষ হবে। অ্যাস্ট্রাজেনিকা সেপ্টেম্বরের শেষেই যুক্তরাজ্যের জন্য তাদের প্রথম ব্যাচ তিন কোটি ডোজ ভ্যাক্সিন বানাবে পরে সরবরাহ করবে আরো সাত কোটি। এরপর ৪০ কোটি ডোজ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সরবরাহ করবে।
সব কিছু ঠিকমতো চললে গ্লোব বায়োটেক তাদের ফেজ থ্রি ট্রায়াল শুরু করতে পারবে আগামী বছরের এপ্রিল বা মে মাসের দিকে। কিন্তু তখন বাংলাদেশে সম্ভত তেমন কোনো করোনা রোগীই থাকবে না। সুতরাং তাদের ফ্রেজ থ্রি ট্রায়াল সম্পন্ন করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে অনেকটা সময় এবং নির্ভর করতে হবে অন্য দেশের ওপর, যেখানে করোনা ইনফেকশন বেশি। এ ধরনের সমস্যায় পড়েছিল অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন। ওরা যখন ফ্রেজ থ্রি ট্রায়াল শুরু করল জুনের শেষে তখন যুক্তরাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমে গেল। পরে ওরা ব্রাজিল ও সাউথ আফ্রিকাতে ভ্যাক্সিন ট্রায়াল শুরু করে। ঠিক এ কারণে গ্লোব বায়োটেকের ফ্রেজ থ্রি ট্রায়াল আগামী বছরের আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের আগে শেষ করা সম্ভব নয়। এরপর তাদেরকে ভ্যাক্সিন প্রোডাকশনে যেতে হবে। এর বিপরীতে আগামী বছর জুনের মধ্যে মডার্না তাদের এমআরএনএ ভ্যাক্সিন বাজারে আনার ব্যাপারে আশাবাদী। চীনও তাদের ভ্যাক্সিন আনতে চাচ্ছে খুব তাড়াতড়ি।
এই মহামারীর সময় গ্লোব বায়োটেক যে নিজ ইচ্ছায় ভ্যাক্সিন প্রোজেক্ট নিয়ে এগিয়েছে তার জন্য তারা অবশ্যই বাহবা পাওয়ার যোগ্য। সরকারের উচিৎ তাদের সর্বাত্মক সহায়তা দেয়া। ভ্যাক্সিন আমাদের লাগবেই, শুধু করোনার জন্য নয়, আরো অনেক রোগের জন্যই লাগবে। সে ক্ষেত্রে তা যদি উৎপাদিত হয় নিজ দেশেই সেটা একটা বিরাট সম্মানের ব্যাপার। তবে গ্লোব বায়োটেক ডিসেম্বরেই ভ্যাক্সিন বাজারে আনার দাবিটি বাস্তব নয়।


আরো সংবাদ



premium cement
পিরোজপুরে বাসের ধাক্কায় নদীতে ৪ মোটরসাইকেল ফরিদপুরে নিহতদের বাড়ি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী টিকটকে ভিডিও দেখে পুরস্কার, প্রভাব ফেলছে মানসিক স্বাস্থ্যে পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে: পাটমন্ত্রী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও নেতাকর্মীরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে : সালাম নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে কাজ করছে সরকার : পরিবেশ সচিব সৌরশক্তি খাতে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় জার্মানি ‘সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই বিচার প্রক্রিয়ার ধীর গতি’ মোদি কি হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের চেনা রাজনীতিতে ফিরছেন? টাঙ্গাইলে বৃষ্টির জন্য ইসতেসকার নামাজ ফুলগাজীতে ছাদ থেকে পড়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু

সকল