১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের ৫ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা

-

বঙ্গোপসাগরে গভীরতা কমে যাওয়ায় উপকূলে সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও তাপমাত্রা বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে এমন হচ্ছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা এটিকে আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর মন্তব্য করে দেশের বিপদ বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা বলছেন, সমুদ্রের তাপমাত্রা, চাপ ও বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করায় ধীরে ধীরে আমাদের বিপদের সময় ঘনিয়ে আসছে। এতে করে ভূমিধস, শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের সাথে আগামী বছর নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলে পাঁচ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গবেষকদের মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বনায়নের হার কমায় ক্ষতি প্রকট হচ্ছে; যা আমাদের ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে চার কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বন্যাঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ সংখ্যা আগের পূর্বাভাস থেকে প্রায় ৯ গুণ বেশি। আগের পূর্বাভাসে ৫০ লাখ মানুষ বন্যাঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় নতুন এই সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। গবেষণাটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ক্লাইমেট সেন্ট্রাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ডিজিটাল এলিভিয়েশন মডেলিং (ডিইএম) ব্যবহার করে স্যাটেলাইটে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষণাটি করেছে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত কারণে এশিয়ার ছয়টি দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এগুলো হচ্ছেÑ চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। বলা হচ্ছে, চীনে সবচেয়ে বেশি মানুষের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে; যার সংখ্যা ৯ কোটি ৩০ লাখ, বাংলাদেশে চার কোটি ২০ লাখ, ভারতে তিন কোটি ৬০ লাখ, ভিয়েতনামে তিন কোটি ১০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় দুই কোটি ৩০ লাখ এবং থাইল্যান্ডে এক কোটি ২০ লাখ। পরিসংখ্যান বলছে, বঙ্গোপসাগর উপকূলে গত ৬০ বছরে প্রায় ৪ গুণ বেড়েছে সাইক্লোনের সংখ্যা। ১৯৭১ সাল থেকে এ বছরের আমফান পর্যন্ত গত ৫০ বছরে দেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে ছোট বড় ৩৩টি ঘূর্ণিঝড়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, ১৯৯৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে বঙ্গোপসাগর উপকূলে আঘাত হেনেছে ৭৮টি ঘূর্ণিঝড়। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ৮১ বছরে যেখানে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল ৩০টি, সেখানে ১৯৬১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬০ বছরে হয়েছে ৪৮টি। এর মধ্যে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে গত এক বছরেই আঘাত হেনেছে তিনটি ঘূর্ণিঝড়। জলবায়ু বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরে বছরে প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় ভয়াবহতায় যোগ করছে নতুন মাত্রা। গতির দিক থেকেও এগুলোর কোনোটি এগিয়ে থাকছে ব্যাপকত্বে, কোনোটি আবার গতি বা জলোচ্ছ্বাসে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমেই বাড়ছে সমুদ্র উপরিভাগের তাপমাত্রা। সমুদ্রের তাপমাত্রা, চাপ ও বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করায় এ ধারা আরো বাড়বে জানিয়ে গবেষকরা মনে করেন, এতে দুর্যোগের সংখ্যা ও মাত্রা বাড়ায় বারবার ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এ বিষয়ে নদী, পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হবো, তাতো পুরনো কথা। ২০০৯ সাল থেকে আমরা বলছি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে আমাদের উপকূলভাগ তলিয়ে যাবে। আক্ষরিক অর্থে আমরা তলিয়ে যাবো না, কারণ আমাদের উপকূলজুড়ে ১৫ ফুট উচ্চতার বাঁধ আছে। কিন্তু বিপদ হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস। যদি জলোচ্ছ্বাস ২০ ফুট উচ্চতার হয়, তবে আমরা তা ঠেকাতে পারব না। আইনুন নিশাতের মতে, ‘উপকূলীয় এলাকার বাঁধই হলো আমাদের রক্ষাকবচ। বিপজ্জনক হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, সমানতালে জলোচ্ছ্বাসও যদি বাড়ে তবেই শঙ্কা। ওই শঙ্কা মোকাবেলা করতে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ক্লাইমেট সেন্ট্রালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাতাসে যদি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ আমরা ব্যাপকমাত্রায় কমিয়ে আনতে পারি, তাহলে হয়তো এমন দুঃখজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। আর কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ যদি বর্তমান মাত্রায় স্থির থাকে, তাহলে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হবে না। তাই আমাদের উচিত, বাতাসে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ব্যাপকমাত্রায় কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করা।’ প্রাকৃতিক দুর্যোগ গবেষক ড. বিশ্বজিৎ নাথ বলছেন, ২.৭ সেন্টিগ্রেড অ্যাভারেজে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এটা একটা অ্যালার্মিং বিষয়। আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বনায়নের হার কমায় এ ক্ষতি প্রকট হচ্ছে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, গ্লোবাল উষ্ণায়নের কারণে দিন দিন বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তাই ঋতুর স্বাভাবিকতা থাকছে না। তারই প্রভাবে দেশে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি, অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ছাড়া কালবৈশাখীর ছোবল, ভারী-হালকা বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, খরা বজ্রঝড়ের সংখ্যাও বাড়ছে। মৌসুমি বায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন অতিভারী বৃষ্টি আবার কখনো হালকা বৃষ্টিপাত বাড়ছে। তার মতে, শীতকালে আগে টানা কুয়াশা পড়লেও তা পরিবর্তিত হয়ে এখন কমে গেছে। সেই সাথে কমছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। এ ছাড়া পরিবর্তন এসেছে তাপপ্রবাহে। এসব কারণেই এ বছরেও দেশে ভূমিধস, তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে মার্কিন গবেষকের আশঙ্কাÑ ভবিষ্যতে প্রবল ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের নিয়মিত শিকার হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির কৃষি, পরিবেশ এবং উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জয়েস জে চেন তার গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যের জটিল সম্পর্কের ওপর গবেষণা করছেন। জয়েস জে চেনের মতে, জলোচ্ছ্বাস এখন বাংলাদেশে প্রতি দশকে একবার করে আঘাত হানছে। ২১০০ সালের মধ্যে তা প্রতি বছর ৩ থেকে ১৫ বার নিয়মিত আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রথাগত জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পরিবেশের চরম অবস্থা তাদের যে দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাতে যে কারো সহিষ্ণুতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি শতাব্দীর শেষে, বাংলাদেশের উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ দশমিক ৫ মিটার বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল