১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর জমি প্লাবিত : পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ

শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জের স্টেশনবাজারে সোমবার রাতে নদীভাঙনে ৮টি প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যায় : নয়া দিগন্ত -

দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যায় হাজার হেক্টর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও পানি কমতে শুরু করলেও মারাত্মক আকারে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে ঘরবাড়ি, স্কুল, দোকান ও ফসলি জমি। এ ছাড়া হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছে।
কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, গতকাল যমুনার তীরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায় চার দিকে অথৈ পানি। রাস্তাঘাটসহ আশপাশের এলাকাগুলো প্লাবিত। এই সময় সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের চরগিরিশ ইউনিয়নে একটি উচ্চবিদ্যালয়সহ ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি উঠেছে। বিদ্যালয়গুলো হচ্ছেÑ রাজনাথপুর নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, জোরবাড়ী, গুঁয়াখড়া, দক্ষিণ সালাল, রাজনাথপুর, সিদ্ধুরআটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়াও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে।
পাশের মনসুরনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক রাজমহর জানান, মনসুরনগর ইউনিয়নে অনেক ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্লাবিত হয়। পানিবন্দী হয়ে পড়ে গোটা চরাঞ্চলের মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষি বিভাগের কৃষকের পাটসহ বিভিন্ন ফসল।
রাজনাথপুর নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল মালেক বিএসসি এই প্রতিবেদককে জানান, এ ইউনিয়নের সাতটি বিদ্যালয়ে পানি উঠে সব বিদ্যালয় তলিয়ে গেছে, প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) কারণে অনেক দিন হলো বিদ্যালয়গুলো বন্ধ আছে বলে জানান তিনি।
শরীয়তপুর সংবাদদাতা জানান, পদ্মার ভাঙনে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া চেয়ারম্যান স্টেশন বাজারে সোমবার গভীর রাতে ৮টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এর ৭ দিন আগে ওই বাজারের আরো ৫টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙন আতঙ্কে মঙ্গলবার বাজার থেকে আরো ২০টি দোকানঘর অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বালু ভর্তি জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্র জানায়, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। এতে হঠাৎ করে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। আর এ ভাঙনে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া চেয়ারম্যান স্টেশন বাজারের দিদার সরকার, দেলু বেপারি, সুমন আসামি, রাজ্জাক মিজি, আঞ্জু সরকার জাহাঙ্গীর খাঁর দোকানসহ সোমবার রাত দেড়টার দিকে ৮টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এসব ব্যবসায়ী তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো মালামাল রক্ষা করতে পারেনি। এর এক সপ্তাহ আগে ওই বাজারের আরো ৫টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এ নিয়ে মোট ১৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হলো। ভাঙন আতঙ্কে ইতোমধ্যে বাজারটির আরো ২০টি দোকানঘর অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী দিদার সরকার বলেন, গতকাল রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাই। সকালে বাজারে এসে দেখি আমার দোকানঘরসহ আরো ৭টি দোকান নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আমার সবকিছু কেড়ে নিলো পদ্মা। আমি এখন পরিবারপরিজন নিয়ে কী করে বাঁচবো। দোকানের আয় ছিল আমার সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আহসান হাবিব বলেন, গত কয়েক দিনে পদ্মার ভাঙনে তারাবুনিয়া স্টেশন বাজারের ১৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনকবলিত ওই স্থানের ৩০০ মিটার এলাকায় ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের কাজ চলছে। ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে একটি প্রকল্প জমা দেয়া হয়েছে।
নাটোর ও নঁওগায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে
বাসস জানান, নাটোর ও নঁওগায় বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। দেশের ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে হ্রাস ৬৩টির এবং ৩৭টি স্টেশনের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
অপর দিকে, অপরিবর্তিত রয়েছে একটির এবং বিপদসীমার ওপরে রয়েছে আটটি।
আজ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে যা, আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
গঙ্গা ও পদ্মার পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
অন্য দিকে আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে বগুড়ায় ৯৫ মিলিমিটার এবং জারিয়াঞ্জাইলে ৩৩ মিলিমিটার।
গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তার নদীর পানি কমতে শুরু করলেও জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার চরাঞ্চলগুলোতে এখনো পানিবন্দী মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এ দিকে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার কিছুটা নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া, শ্রীপুর, হরিপুর, গাইবান্ধা সদরের কামারজানি, ফুলছড়ির কাতলামারি, সিংড়িয়া, কামারপাড়া এবং সাঘাটার গোবিন্দি ও হলদিয়ার বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক ভাঙনের ফলে গত তিন দিনে সাড়ে ৩০০ ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে।
অপরদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়। এ বন্যায় ২৩ হাজার ৮৬৫টি ও প্রায় ৩৬ কিমি রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বন্যায় জেলায় ৩ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমির পাটসহ শাকসবজি ও বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এসব ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২০০ টন চাল, ১ হাজার ৮০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ত্রাণ হিসেবে বন্যার্তদের মধ্যে নগদ ১৩ লাখ টাকা এবং গোখাদ্য হিসেবে ২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়। অপরদিকে সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে, বন্যা দুর্গত এলাকায় তাদের ৬১টি মেডিক্যাল টিম স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামের সব ক’টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধরলা নদীর পানি সদর পয়েন্টে সামান্য উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি কমায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্ভোগ কমেনি বানবাসীদের। ধরলার প্রবল ভাঙনের মুখে পড়েছে সারোডোব ও জয়কুমোর এলাকা।
বন্যার্ত ফারুন, জোবেদ আলী, আমিনুল ইসলাম বলেন, পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে থাকায় তারা পাকা সড়ক, বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার্ত এলাকায় চলছে গোখাদ্যের সঙ্কট। কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শহিদুল ইসলাম জানান, চলতি বন্যায় ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনে বিলীন ও একটি বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে রয়েছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ১৫২টি বিদ্যালয়ের। ভাঙনে বিলীন বিদ্যালয়ের মধ্যে উলিপুর উপজেলার চরবজরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নয়াডারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রৌমারী উপজেলার বলদমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফলুয়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া উলিপুরের সুখেরবাতির চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে রয়েছে।
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, বন্যায় মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি টাকার। কুড়িগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মোস্তাফিজার রহমান প্রধান জানান, আমন ধানের বীজতলার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষক পর্যায়ে কমিউনিটি বীজতলা স্থাপন করা হবে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, ভাঙন রোধে জেলার ১৯টি পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে।
কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী) সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় যমুনেশ্বরী নদীর ভাঙনে হুমকির মুখে চাঁদখানা সরঞ্জাবাড়ী গ্রামের মসজিদ, কবরস্থান, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ দেড় শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি। ইতোমধ্যে ওই গ্রামের এক কিলোমিটার একটি কাঁচা রাস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, নদী খননে পশ্চিম তীর বাঁধা হয়। ফলে পূব তীরে ব্যাপক আকারে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে রাতারাতি নদীতে ভেঙে যায় ফসলি জমি, বাঁশঝাড়সহ শত শত ফলদ গাছ। এখন কবরস্থান, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মসজিদসহ বাপ-দাদার রেখে যাওয়া পৈতৃক ভিটে নদীর ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। নদীভাঙন প্রতিরোধে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হলে দেড় শতাধিক পরিবার ভিটে হারা হয়ে পড়বে বলে এলাকাবাসী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সৈয়দপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কৃষ্ণ কমল বলেন, যমুনেশ্বরী নদীভাঙনের মুখে চাঁদখানা সরঞ্জাবাড়ি গ্রামের কিছু বাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বরাদ্দ চেয়ে আবেদন পাঠিয়েছি। আশা করি তাড়াতাড়ি বরাদ্দ পাওয়া যাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, নদীভাঙনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement