২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এন্ড্রু কিশোরের বিদায়

-

ঢালিউডের প্লেব্যাক সম্রাট কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর আর নেই। দীর্ঘ ১০ মাস মারণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগে তিনি চিরতরে চলে গেলেন দুনিয়ার মায়া ছেড়ে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় রাজশাহীতে শিল্পীর বোনের নিজস্ব ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাজারো ভক্ত অনুরাগীকে কাঁদিয়ে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। এন্ড্রু কিশোরের বড় বোনের স্বামী ডা: প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার পর এই সঙ্গীতশিল্পী রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় তার বোন ডা: শিখা বিশ্বাসের বাসায় ছিলেন। শিখা বিশ্বাসের ওই বাসার একটি অংশেই রয়েছে ক্লিনিক। সেখানেই এন্ড্রু কিশোরের চিকিৎসা চলছিল। গত রোববার থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তাই এন্ড্রু কিশোরের সুস্থতায় সবার কাছে প্রাণ খুলে দোয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু। তার শারীরিক অবস্থার অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল দুপুরে বাড়িতে রেখেই তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হয়। এরপর সন্ধ্যায় তিনি মারা গেলেন।
এন্ড্রু কিশোরকে দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা শফিকুল আলম বাবু সাংবাদিকদের জানান, দেশে ফিরলেও এন্ড্রু কিশোরের শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। রোববার সকালের দিকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তিনি কারো সাথে কথা বলার মতো অবস্থাতেই ছিলেন না। বিকেলে এন্ড্রু কিশোরের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছিল।
কয়েক মাস ধরে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১১ জুন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে রাজশাহীতে চলে যান। শেষ হলো জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পীর জীবনের গল্প।
এন্ড্রু কিশোরের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা দু’জনই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন আর ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন।
তার পারিবারিক সদস্যরা জানান, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি নিজের ইচ্ছায় দেশে ফিরতে চেয়েছেন। বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।’
শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তার শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তার চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে কয়েক মাস একনাগাড়ে চিকিৎসা চলে। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চিরবিদায় নেন তিনি।
এর আগে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে গত মে মাসের ১৩ তারিখ দেশে ফেরার টিকিট কেনা হয়েছিল বলে জানান তার স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল বোধ করছিলেন। তাই বাতিল করা হয় টিকিট।
চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, এই দুর্বলতা কেমোর ধকল। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। চিকিৎসক আশ^স্ত করায় ১০ জুন ফেরার টিকিট কেনা হয়েছিল। কিন্তু ২ জুন হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে যান শিল্পী। পরদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ৪ জুন। কোনো ওষুধই আর কাজ করছিল না শরীরে। পিইটি স্ক্যান হয় ৯ জুন। সে রিপোর্টে দেখা গেল লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার ও স্পাইনালে ছড়িয়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গাতেও অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা দুঃখের সাথে জানিয়ে দেন, আর কিছুই করার নেই।
বাংলা গানের এই কণ্ঠশিল্পী ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের আধুনিক ও চলচ্চিত্র জগতের কালজয়ী অনেক গান তার কণ্ঠে সমৃদ্ধ হয়েছে। সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ সব অনুভূতির গানই তিনি গেয়েছেন।
১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে সঙ্গীতের পাঠ শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর তিনি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক, দেশাত্মবোধকসহ প্রায় সব ধারার গানে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত হন।
চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোর গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। ছবির নাম ‘মেইল ট্রেন’। পরিচালক শিবলী সাদিক। এ ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি। চলচ্চিত্রে এটাই ছিল তার প্রথম গান। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর সবার কাছে পৌঁছে যান দুই বছর পর। তার এই গান ছিল ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায় গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি।
গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্লেব্যাক ও স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। আলম খানের সুর-সঙ্গীতে গেয়েছেন সব্যসাচী লেখক ও কবি মরহুম সৈয়দ শামসুল হকের লেখা শেষ তিনটি গান। তিনি দেশের প্রখ্যাত সুরকারদের মধ্যে বেশি গান করেছেন আলম খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে। এ ছাড়া গান করেছেন শেখ সাদী খান, ইমন সাহা, আলী আকরাম শুভসহ অনেকের সঙ্গে। ভারতের প্রখ্যাত সুরকার আর ডি বর্মণের সুরেও গান গেয়েছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতায়ও প্লেব্যাকে বেশ কয়েকটি গান করেছেন।
মাঝে কিছু দিন ব্যবসাও করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর প্রমুখের সঙ্গে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন।
এন্ড্রু কিশোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘এইখানে দুইজনে নির্জনে’সহ অনেক গান।
জীবনের বেশির ভাগ সময়ে এন্ড্রু মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন। চলচ্চিত্রে তিনি এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ইত্যাদিতে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে আরো বেশ কয়েকবার ইত্যাদিতে এসেছেন।
রাষ্ট্রপতির শোক : রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী সঙ্গীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি পরলোকগত কিশোরের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী, দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এন্ড্রু কিশোরের অবদানকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্রে অনেক জনপ্রিয় গান গেয়েছেন এবং সেজন্য তিনি দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘তার মৃত্যু দেশের সঙ্গীতাঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
শেখ হাসিনা প্রয়াতের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী গায়ক এন্ড্রু কিশোর আজ বিকেলে তার পৈতৃক নিবাস রাজশাহীর একটি ক্লিনিকে মারা যান। তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম জানান, এর আগে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এন্ড্রু কিশোরের চিকিৎসার দায়িত্বভার গ্রহণ করে শিল্পীকে আর্থিক সহযোগিতাও প্রদান করেন।
তথ্যমন্ত্রীর শোক : তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গভীর শোক জানিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ তার শোকবার্তায় বলেন, দরাজ কণ্ঠ আর কালজয়ী গানের মাঝে এন্ড্রু কিশোর বাঙালির হৃদয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। চার দশকের বেশি ধরে দেশ ও বিদেশের মানুষের মন জয় করা আটবার জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত এই সঙ্গীত প্রতিভার কণ্ঠে মানব মনের সূক্ষ্ম অনুভূতির অনুরণন কখনো ভোলার নয়।


আরো সংবাদ



premium cement
কালিয়াকৈরে ছিনতাইকারীর অস্ত্রের আঘাতে স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাবা-ছেলে আহত কাপাসিয়ায় চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২ রাশিয়ার ২৬টি ড্রোন ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র মাগুরায় বজ্রপাতে ২ যুবকের মৃত্যু মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ‘অস্থায়ীভাবে’ ক্ষমতায় রয়েছে : জান্তা প্রধান গাজীপুরে কাভার্ডভ্যানের চাপায় মোটরসাইকেলচালক নিহত উত্তরপ্রদেশে কারাগারে মুসলিম রাজনীতিবিদের মৃত্যু : ছেলের অভিযোগ বিষপ্রয়োগের দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস খাদে, নিহত ৪৫, বাঁচল একটি শিশু ইসরাইলের রাফা অভিযান পরিকল্পনা স্থগিত এগিয়ে নিয়ে গিয়েও জেতাতে পারলেন না ত্রিস্তান

সকল