২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণিতের প্রভাব পড়েছে এবারের ফলাফলে

-

নাটোরের প্রত্যন্ত গ্রামের চাঁদপুর রফাতুল্লা সোনার উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে সানজিদা খাতুন। স্কুলটির প্রথম হওয়া এই ছাত্রীর ১৪টি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর ৮৮ শতাংশ। কিন্তু সাধারণ গণিতে পেয়েছে মাত্র ৭৪ নম্বর। এতে ছুটে যায় তার গোল্ডেন এ প্লাস। একই পরিণতির শিকার হয়েছে এবারের এসএসসির অনেক ফলপ্রার্থী।
শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কাছে এবার কঠিন বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে গণিত। না হলে এবার পাসের হার আগের বছরের চেয়ে অনেক বাড়ত। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের বিষয়ভিত্তিক পাসের হার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যে বোর্ডের শিক্ষার্থীরা গণিত বিষয়ে ভালো করেছে, সেখানে পাসের হার বেড়েছে। আবার যেখানে এ বিষয়ে পাসের হার কম, সেখানে বোর্ডের পাসের হারও গত বছরের তুলনায় কম।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা জানান, এ বছর গণিতই পেছনে ফেলে দিয়েছে গড় পাসের হার। এবার গণিতের প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। সৃজনশীল গণিতের সাথে বিশেষ করে মানবিক এবং ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীরা খাপ খাওয়াতে পারেনি। অনেক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের এবং নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণিতের শিক্ষক নেই। এ বিষয়ে যোগ্য শিক্ষকেরও ঘাটতি থাকায় গণিতে তারা ভালো করতে পারেনি।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। যে কারণে জিপিএ ৫ এর সংখ্যা বেড়েছে। একজন শিক্ষার্থী যদি মনোযোগ সহকারে পড়াশুনা করে সে তার প্রাপ্য নম্বর পাবে। সে ক্ষেত্রে আমরা তো আটকাতে পারি না। যদিও পাসের হার ও জিপিএ ৫ বাড়ার জন্য কেউ কেউ উত্তরপত্র মূল্যায়নে উদারতাকে চিহ্নিত করতে চান। তবে এসব দাবি একেবারেই উড়িয়ে দিয়ে জিয়াউল হক বলেন, আসলে গত বছরের তুলনার এবার বিজ্ঞান ও মানবিকের শিক্ষার্থীদের জিপিএ ৫ বেড়েছে। যে কারণে মোট জিপিএ ৫ এর সংখ্যা বেড়েছে। তার মতে, গত কয়েক বছরের চেয়ে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের গড় মেধা অনেক বেশি। তারা কাক্সিক্ষত ফলাফল পেয়েছে।
ভালো ফলের সূচক হিসেবে চারটি দিক ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে-পাসের হার, মোট জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শতভাগ ও শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এবার চারটি সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলকে ভালো বলছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এ ভালো ফলাফল করার পেছনে পাঁচটি ইতিবাচক দিককে চিহ্নিত করে তারা বলছেন, পাসের হার ও জিপিএ ৫ বাড়ার নেপথ্যে মোটাদাগে ইংরেজি, বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগে গত বছরের তুলনায় ভালো করা, প্রশ্নফাঁস না হওয়া, নকলের সুযোগ কমে যাওয়ায় পড়াশুনার দিকে মনযোগী হওয়ার ইতিবাচক প্রভাব আছে ফলাফলে। এবার পাসের হার সামান্য বাড়লেও জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে ৩০ হাজারের বেশি। ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে ভালো হওয়ায় জিপিএ ৫ বেড়েছে। ফলাফলের চিত্রটা আরো ভালো হতো যদি গত বছরের মতো এবারো গণিতে সব বোর্ডের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক খারাপ না করত।
বোর্ডভিত্তিক পাসের হার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১টি বোর্ডের মধ্যে পাসের হারের শীর্ষে রাজশাহী বোর্ড। গত বছরের চেয়ে পাসের হার ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়লেও এবার বোর্ডভিত্তিক পাসের হারে সবার নিচে সিলেট বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৮৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, গত বছর ছিল ৭৮ দশমিক ১১ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বোর্ডে হঠাৎ করে পাসের হার ও জিপিএ ৫ বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে এ বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, পার্বত্য তিন জেলায় সরকার কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়ায় সেখানকার শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে পড়াশুনায় মনোযোগী হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বোর্ডের গড় ফলাফলে। সারা দেশে এবার সাধারণ গণিত বিষয়ের প্রশ্ন তুলনামূলক কঠিন হয়েছে। না হলে পাসের হার আরো বাড়ত। তিনি আরো বলেন, যোগ্য শিক্ষকদের পরীক্ষক নির্বাচন করায় সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করায় জিপিএ ৫ বেড়েছে।
সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, গত বছরের চেয়ে ইংরেজিতে ২ শতাংশ ও গণিতে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বেশি পাস করায় পাসের হার বেড়েছে। এ বোর্ডে শতভাগ ফেল করা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কঠোর মনিটরিং করায় এ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে এ বছর পাস করেছে ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাস করেছে ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। গত বছর পাসের হার ছিল ৭২ দশমিক ২৪ শতাংশ। নতুন শিক্ষা বোর্ড ময়মনসিংহে পাসের হার ৮০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
মাদরাসা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন বলেন, এবার গণিতের প্রশ্ন বিগত বছরের তুলনায় কঠিন হওয়ায় পাসের হার সামান্য কমেছে। গত বছর গণিতে পাসের হার ছিল ৯৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ, এবার সেখানে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তবে অন্যান্য সূচকে উন্নতি হয়েছে। যেমন, শতভাগ পাস করা মাদরাসার সংখ্যা বেড়েছে। শতভাগ ফেল করা মাদরাসার সংখ্যাও কমেছে।
বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, বিষয়ভিত্তিক পাসের হার কেবল বোর্ডের ফলেই নয়, জিপিএ ৫ প্রাপ্তির ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সারা দেশে (১১ বোর্ড মিলে) গত বছরের চেয়ে ৩০ হাজার ৩০৪ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ বেশি পেয়েছে।
এ ব্যাপারে কুমিল্লা বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম বলেন, গত বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ পাস কমার কারণ হলো সাধারণ গণিতের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন কঠিন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। ২০১৭ সালে আমাদের বোর্ডে ফলাফল খারাপ করার পর আমরা যেসব বিষয় শিক্ষার্থীরা দুর্বল সেসব বিষয়ে শিক্ষকদের নিয়ে সভা করেছি। বিশেষ করে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও আইসিটি বিষয়ে দুর্বলতা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়ায় জিপিএ ৫ এর সংখ্যা বেড়েছে।
এবার মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে বেড়েছে পাসের হার। এই দুই বিভাগে যথাক্রমে পাসের হার ৭৬ দশমিক ৩৯ ও ৮৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত বছর মানবিকে পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৩২ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৮৩ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এবার বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৯৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় পাসের হার সামান্য কমলেও জিপিএ ৫ এর সংখ্যা বেড়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement