১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

লিবিয়ায় গুলিবর্ষণে ২৬ বাংলাদেশী নিহত

জিম্মি ঘটনার জের
-

লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির কাছে মিজদাহ এলাকায় মিলিশিয়াদের গুলিবর্ষণে ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জন নিহত হয়েছেন। নিহত অপর চারজন আফ্রিকান নাগরিক। এ ঘটনায় আরো ১১ জন বাংলাদেশী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। তাদের ত্রিপোলিতে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আহতদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিজদাহ শহরের নিরাপত্তা বিভাগকে দোষীদের গ্রেফতারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দেশটি বলছে, এই গণহত্যার পেছনে উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অনুমতি কারো নেই।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিজদাহতে (ত্রিপোলি হতে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে) কমপক্ষে ২৬ জন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার তথ্য পাওয়া গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে দূতাবাসের অনুসন্ধানে জানা যায়, লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ২৬ জন বাংলাদেশী ঘটনাস্থলে নিহত হন। একজন বাংলাদেশী সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তিনি এক লিবীয় নাগরিকের আশ্রয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশী টেলিফোনে দূতাবাসকে জানান, ১৫ দিন আগে কাজের সন্ধানে থাকা বাংলাদেশীসহ অন্য অভিবাসীদের নিয়ে মানবপাচারকারীরা মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ত্রিপোলির দিকে যাচ্ছিল। পথে মিজদাহ শহরের কাছে লিবীয় মিলিশিয়া বাহিনীর একদল দুষ্কৃতকারীর হাতে তিনিসহ ৩৮ বাংলাদেশী জিম্মি হন। মুক্তিপণ আদায়ের তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে অপহৃত ব্যক্তিদের হাতে মূল অপহরণকারী লিবীয় নিহত হন। এর প্রতিশোধ নিতে লিবীয় মিলিশিয়া বাহিনী তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে ২৬ জন বাংলাদেশী নিহত এবং ১১ জন বাংলাদেশী হাতে, পায়ে, বুকে ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হন।
এই খবর পাওয়ার পর লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা মিজদাহ হাসপাতালের পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া লাশগুলো মিজদাহ হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী সময়ে আহত বাংলাদেশীদেরকে দূতাবাসের সহায়তায় উন্নততর চিকিৎসার জন্য ত্রিপোলিতে অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। গুরুতর আহতদের শরীর থেকে গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস লিবিয়ার স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। লিবিয়া সরকার ও আইওএম আহত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা আহতদের কাছ থেকে ঘটনার বিশদ বিবরণসহ নিহতদের পরিচয় জানার চেষ্টা করছেন। দূতাবাস লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরো ঘটনার তদন্ত করে এজড়িতদের গ্রেফতার, দোষীদের যথাযথ শাস্তি বিধান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিজদাহের সুরক্ষা বিভাগকে অপরাধীদের গ্রেফতার এবং বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
প্রসঙ্গত মিজদাহ শহরে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এ অঞ্চলটি লিবিয়ার বিবদমান দুই শক্তিশালী পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত ত্রিপোলিভিত্তিক জিএনএ সরকার মিজদাহ দখল করে নেয়। তবে জেনারেল হাফতার নেতৃত্বাধীন পূর্বভিত্তিক সরকারি বাহিনী দু’দিন আগেও শহরটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। এ অঞ্চলের ওপর ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। বর্তমানে এমনকি ত্রিপোলি শহরেও বিরোধীপক্ষ মাঝেমাঝে বোমাবর্ষণ করে থাকে। দু’টি শক্তিশালী পক্ষ যুদ্ধরত থাকায় লিবিয়ার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নয়। এ কারণে অধিকাংশ দেশ তাদের দূতাবাস লিবিয়া থেকে প্রতিবেশী তিউনিসিয়ায় স্থানান্তর করেছে। এখন বাংলাদেশসহ তিনটি দেশ ত্রিপোলিতে দূতাবাসের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
মিজদাহের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন আহত বাংলাদেশীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসকে নির্দেশ দিয়েছেন। গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, মানবপাচারকারীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশীসহ এসব লোককে ইতালিতে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। মানবাপাচারের এ অবৈধ প্রক্রিয়ায় জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনা ঘটে। এবার পাচারের শিকার বাংলাদেশীরা তিন মাস আগে লিবিয়ায় যায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, মিজদাহর ঘটনায় আহত ১১ জনের মধ্যে ছয়জন চিকিৎসার পর সুস্থ রয়েছেন। তবে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই পাঁচজনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে বুলেট ঢুকেছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বুলেটগুলো বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মিজদাহ এলাকাটি সপ্তাহখানেক আগে ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারি বাহিনী দখলে আনলেও সেখানে কার্যত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এলাকাটিতে বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ তৎপরতা রয়েছে। তাই বাংলাদেশীদের ওপর গুলিবর্ষণের সাথে জড়িতদের কবে নাগাদ শাস্তির আওতায় আনা যাবে তা আমরা বলতে পারছি না। তবে এই মানবপাচারের সাথে জড়িত বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। মিজদাহর ঘটনায় আহতদের কাছ থেকে এ জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। মানবপাচারের সাথে জড়িত বাংলাদেশীদের গ্রেফতারের আওতায় আনা না গেলে অবৈধ এই প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না।
আইওএমের মাধ্যমে নিহত বাংলাদেশীদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও জানান ড. মোমেন। লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম বিষয়ক কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম জানান, ইতালিতে অবৈধ অভিবাসনের উদ্দেশ্যে করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর আগে ডিসেম্বর মাসে ভারত ও দুবাই হয়ে ৩৮ জন বাংলাদেশী বেনগাজি পৌঁছান। এরপর গত কয়েক মাস তাদেরকে লিবিয়ার ভেতরে গোপনে রাখা হয়েছিল। লিবিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল জুওয়ারা হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে ইতালির দিকে যাত্রা করার পরিকল্পনা ছিল পাচারকারীদের। তল্লাশি এড়াতে পাচারকারীরা প্রচলিত পথে না গিয়ে মরুভূমির মধ্য দিয়ে বেশ বিপদসঙ্কুল একটি পথে তাদের নিয়ে যাচ্ছিল। এই পথে তারা অপহরণকারীদের কবলে পড়েন। আশরাফুল ইসলাম জানান, মরুভূমির পথটি সশস্ত্র মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণাধীন, যারা অনেক দিন ধরে সরকারহীনতার সুযোগ নিয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অপহরণের পর মিজদাহতেই প্রায় ১৫ দিন জিম্মি ছিলেন অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশী ও সুদানি নাগরিকরা। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে অপহরণকারীরা। এক পর্যায়ে বাংলাদেশীদের সাথে থাকা সুদানি নাগরিকরা অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে মেরে ফেলেন। এরপর অপহরণকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
বিচার দাবি ব্র্যাকের : লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত মানবপাচারকারী চক্রকে দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এ বিষয়ে প্রয়োজনে বাংলোদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিতে হবে। কারণ লিবিয়ার এ পাচারকারী চক্র ইউরোপে পাঠানোর নামে দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের জিম্মি ও নিপীড়ন করছে। এরই সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশীরা। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান।
পরিচয় মিলেছে নিহত ২৪ বাংলাদেশীর : লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের এক সদস্যের সহযোগী ও তার স্বজনদের হাতে হতাহত বাংলাদেশীদের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে দেশটিতে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস। হতাহতদের মধ্যে ‘নিখোঁজ বা মৃত’ হিসেবে ২৪ জনের এবং আহত হিসেবে ১১ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
‘নিখোঁজ বা মৃত’ ২৪ জন হলেনÑ গোপালগঞ্জের সুজন ও কামরুল, মাদারীপুরের জাকির হোসেন, সৈয়দুল, জুয়েল ও ফিরোজ; রাজৈরের বিদ্যানন্দীর জুয়েল ও মানিক; টেকেরহাটের আসাদুল, আয়নাল মোল্লা (মৃত) ও মনির; ইশবপুরের সজীব ও শাহীন, দুধখালীর শামীম; ঢাকার আরফান (মৃত); টাঙ্গাইল নারায়ণপুরের লাল চান্দ; ভৈরবের রাজন, শাকিল, সাকিব ও সোহাগ; রসুলপুরের আকাশ ও মো: আলী, হোসেনপুরের রহিম (মৃত) এবং যশোরের রাকিবুল।
অপর দিকে আহত ১১ জন হলেনÑ মাদারীপুর সদরের তীর বাগদি গ্রামের ফিরোজ বেপারী (হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ), ফরিদপুরের ভাঙ্গা দুলকান্দি গ্রামের মো: সাজিদ (পেটে গুলিবিদ্ধ), ভৈরব শম্ভপুর গ্রামের মো: জানু মিয়া (পেটে গুলিবিদ্ধ), ভৈরব জগন্নাথপুর গ্রামের মো: সজল মিয়া (দুই হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন), গোপালগঞ্জ মুকসুদপুরের বামনডাঙ্গা বাড়ির ওমর শেখ (হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও আঙুলে কামড়ের দাগ, দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ), টাঙ্গাইল নারায়ণপুরের মো: তরিকুল ইসলাম (২২), আলমডাঙ্গা বেলগাছি খেজুরতলার মো: বকুল হোসাইন (৩০), মাদারীপুর রাজৈরের কদমবাড়ির মো: আলী (২২), ভৈরব সখিপুরের মওটুলীর সোহাগ আহমেদ (২০), রাজৈর ইশবপুরের মো: সম্রাট খালাসী (২৯) এবং চুয়াডাঙ্গার বাপ্পী (মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ)। এরা সবাই ত্রিপোলি মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসাধীন।


আরো সংবাদ



premium cement