২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিদেশী বিনিয়োগ নির্ভরতায় ঝুঁকছে দেশের বিদ্যুৎ খাত

২১ প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নের জন্য দাতা খুঁজছে; ১১০ প্রকল্পে দরকার প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা
-

স্পর্শকাতর বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগ নির্ভরতার দিকে ঝুঁকছে সরকার। এ খাতের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে উন্নয়নসহযোগীদের কঠিন শর্তের ঋণসহায়তায়। বিদেশী সাহায্য পাওয়ার সুবিধার্থে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দবিহীন ২১টি নতুন প্রকল্প রাখা হয়েছে। আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন ৭২ হাজার কোটি টাকা। আগামী তিন থেকে পাঁচ অর্থবছরে ওই নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ অর্থের জন্য সরকার ১০টি ঋণদানকারী সংস্থা ও দেশকে টার্গেটে রেখেছে। নতুন-পুরাতন প্রকল্প মিলে মোট ১১০টি প্রকল্পের জন্য দরকার হচ্ছে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সদ্য অনুমোদিত এডিপিতে আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ২৪ হাজার ৬০৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা মোট এডিপির ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ। সরকার নতুন এডিপিতে বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধায় বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত প্রকল্প নিয়েছে ২১টি। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ঋণ পেতে রুশ ফেডারেশন, এক্সিম ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), কেএফডব্লিউ, এআইআইবি, ইডিসিএফ, জাইকা, জার্মানি এবং এএফডির সাথে যোগাযোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, আগামী ২০৪১ সালের ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের ৭০ শতাংশই সরকারের। তবে আগামীতে বিপুল অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। গত ১০ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন তিন গুণ বেড়ে সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। আর বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রকৃত উৎপাদনসক্ষমতা এখন প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট। ২০৪১ সালে উৎপাদনসক্ষমতা ৬০ হাজার মেগাওয়াটে নিতে চায় সরকার। ২০৩০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ৩৩ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালে এটা বেড়ে হবে ৫২ হাজার মেগাওয়াট। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ঘণ্টায় ৪৬৪ কিলোওয়াট, যা আগামী ২০৩০ সালে ৮১৫ এবং ২০৪১ সালে হবে এক হাজার ৪৭৫ কিলোওয়াট।
সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সূত্র ও এডিপির তথ্যানুযায়ী, আগামী অর্থবছর থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সরকার মোট ২১টি প্রকল্প ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশী সাহায্য পাওয়ার সুবিধার্থে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় যুক্ত করেছে। এসবের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট তিনটি প্রকল্প, সঞ্চালনের সাথে সংশ্লিষ্ট সাতটি প্রকল্প এবং বিতরণের সাথে সংশ্লিষ্ট ১১টি প্রকল্প রয়েছে। এর সবই নতুন প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫৬ শতাংশ বা ২১ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে বিদেশী ঋণসহায়তা থেকে। আর বাকি ৪৪ শতাংশ বা ১৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি, পাওয়ার সেল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), ঢাকা ইলেকট্র্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের (বিপিএমআই) অধীনে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে।
বড় ব্যয়ের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১৭ হাজার ১০৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয়ে এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেনথেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি এরিয়া (পিজিসিবি অংশ)। চার বছরে বাস্তবায়নে এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এক্সিম ব্যাংককে রাখা হয়েছে। এখানে ৬৪ শতাংশ অর্থায়ন বিদেশী ঋণ থেকে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চারটি বড় প্রকল্পে এডিবি, জাইকা, বিশ্বব্যাংক এবং এআইআইবি থেকে ঋণ নেয়ার কথা ভাবছে সরকার। আর এগুলো হলো নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ। এর মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ বিভাগের প্রকল্প খরচ ৯ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম-সিলেট বিভাগের প্রকল্পে ৬ হাজার ২১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, খুলনা-বরিশাল বিভাগের প্রকল্পে ৬ হাজার ২৪ কোটি টাকা এবং রাজশাহী-রংপুর বিভাগের প্রকল্পের খরচ ৪ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। পায়রা-গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪ শ’ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। চার বছরে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এ প্রকল্পে ঋণ নেয়ার জন্য এডিবির সাথে আলোচনা করবে সরকার।
বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের মধ্যে গজারিয়ায় ৬ শ’ মেগাওয়াট গ্যাস বা এলএনজিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে প্রয়োজন ৪ হাজার ৬০৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তিন বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। একনেকে অনুমোদন পেলে ময়মনসিংহে ৪২০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলতি বছরই শুরু করার কথা। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ হবে পল্লী বিদ্যুতের ৩১ লাখ স্মার্ট প্রি- পেইড মিটার স্থাপনে। দু’হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে ঢাকা পবিসের-৪ ওভারহেড বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাকে ভুগর্ভস্থ বিতরণ ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, এ জন্য গত ১০ বছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে এক হাজার ৭ শ’ কোটি ডলার। ৭৯টি বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য অর্থায়নের প্রয়োজন হবে ২৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা এবং ৯টি কারিগরি প্রকল্পের জন্য ৯৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। তবে সরকার নতুন প্রকল্পের জন্য এক শ’ কোটি টাকা থোক রেখেছে। বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত ১১টি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৪ হাজার ৯১২ কোটি টাকা অর্থায়নের প্রয়োজন হবে।


আরো সংবাদ



premium cement