২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সুনসান নীরবতা, পাল্টে গেছে নগর-মহানগরের চেনা রূপ

ব্যস্ত মতিঝিল গতকাল ছিল মানুষ ও যানবাহনশূন্য। শাপলা চত্বর থেকে ছবিটি তুলেছেন আব্দুল্লাহ আল বাপ্পী : নয়া দিগন্ত -

রোদ ঝলমলে দুপুর। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগেরই আভাস নেই। স্বাভাবিক সময়ে এই বেলায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা থাকে লোকারণ্য। মিনিটে কতো গাড়ির যাতায়াত! ফুটপাথে গায়ে গায়ে লেগে থাকে মানুষের ভিড়। সেই মতিঝিলে সুনসান নীরবতা। শাপলা চত্বরে একজন পথচারীও নেই। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে টিকাটুলির ইত্তেফাক মোড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অথচ এক দিন আগেও এই ঢাকার মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি এমন একটি সময় আসতে পারে। ব্রাদার্স ক্লাবের সামনের এক বাড়িওয়ালা জানালেন, ৬০-৬৫ বছর আগে তারা যখন ছোট তখন কোনো কোনো সময় এমন দৃশ্য দেখা যেত। তা-ও হঠাৎ হঠাৎ। অথচ করোনা আতঙ্ক ঢাকাকে সেই অর্ধশত বছর পেছনে নিয়ে গেছে।
শুধু ঢাকাই নয়, গতকাল দেশের সব শহর-বন্দরেই এই একই চিত্র দেখা যায়। মনে হয়েছে জনমানবহীন হয়ে পড়েছে লোকালয়গুলো। এমনকি, কোনো কোনো এলাকায় রিকশার টুংটাং শব্দও শোনা যায়নি। বাড়ি-ঘরের ভেতর থেকে আসা আওয়াজগুলোও ছিল ক্ষীণ। এ যেন আতঙ্কে চুপসে গেছে মানুষ।
রাজধানীর মতিঝিল, কমলাপুর, মানিকনগর বিশ্বরোড, গোপীবাগসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে গতকাল এক অচেনা রূপ দেখা যায়। যানবাহন নেই, মানুষজন নেই, দোকানপাট বন্ধ-সব মিলিয়ে এক ভয়ানক পরিবেশ। যে দু-চারজন মানুষ অতি জরুরি কোনো কাজে বের হয়েছেন তারাও যেনো খুবই ব্যস্ত বাসায় ফেরার জন্য। গতকাল দুপুরের দিকে দেখা যায় আর কে মিশন রোডের সব দোকানই বন্ধ। এমনকি, ওষুধের দোকানগুলোও খোলা নেই। রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই। এমনকি রিকশাও না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও দেখা গেছে কড়া প্রহরায়। গতকাল দেখা গেছে রাস্তায় কাউকে দেখলে পুলিশ তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। যেতে না চাইলে তাদের উপর বল প্রয়োগ করতেও দেখা গেছে। মতিঝিলে গতকাল দুপুরের দিকে কথা হয় পুলিশের এক কর্মকর্তার সাথে। তিনি জানালেন, তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে মানুষকে ঘরে রাখতে চাইছেন। কেউ না শুনলে প্রয়োজনে তারা বল প্রয়োগ করছেন। এর বাইরে আর কিছুই করার নেই। মানুষকে অবাধে বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেয়া যাবে না। এতে করোনার ঝুঁকি বাড়বে। ওই কর্মকর্তা বলেন, মানুষেরও উচিত ঘরের ভেতরে থাকা। অতি জরুরি প্রয়োজন না হলে কারো ঘরের বাইরে বের হওয়া উচিত না। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোও গতকাল বন্ধ দেখা গেছে। ফকিরাপুল কাঁচাবাজার, মতিঝিল কলোনি বাজারসহ আশপাশের বাজারগুলোতে হাতেগোনা দু-একটি দোকান খোলা দেখা গেছে। তবে ওইসব দোকানে কোনো ক্রেতা লক্ষ্য করা যায়নি।
রাজধানীতে গতকাল একটিও গণপরিবহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। এমনকি, রাইড শেয়ারের মোটরসাইকেলগুলোও চলতে দেয়নি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তবে দু-চারটি প্রাইভেটকার কালেভদ্রে দেখা গেছে। সন্ধ্যার পরে কিছু পণ্যবাহী কিছু ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান লক্ষ করা গেছে। গতকাল বিকেলে খোকন নামের এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ফার্মগেট থেকে মতিঝিল আসার কোনো বাহন না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। গতকাল সকালের দিকে দু-চারটি বাস এবং হিউম্যানহলার যাত্রী পরিবহনের জন্য রাস্তায় নামলেও পুলিশের বাধার কারণে সেগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় মালিক-শ্রমিকরা। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কয়েকজনের সাথে আলাপ করা হলে তারা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত তারা মানতে বাধ্য। করোনার প্রভাব থেকে বাঁচতে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন তারা।
মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেলের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে এবং এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের সব সিদ্ধান্ত জনগণকে মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত ছুটি ও গণপরিবহন, দোকানপাট বন্ধ থাকায় থমকে গেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জীবনযাত্রা। কার্যত লকডাউনে পুরো চট্টগ্রাম। গণমাধ্যমে কর্মরতরা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কিছু দোকানি ও স্বল্প আয়ের হাতেগোনা কিছু লোকজন ছাড়া কেউই ঘর থেকে বাইরে বের হননি।
সরেজমিন দেখা গেছে, বন্দর নগরীর রাজপথ-অলিগলি প্রায় ফাঁকা। মাঝে মধ্যে অবশ্য জরুরি প্রয়োজনে বেরোনো কিছু যানবাহন আর রিকশা রাজপথে চোখে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধ কেনাকাটা ছাড়া পারতপক্ষে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছেন না। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দিনেও শহীদ মিনারমুখী জনস্রোত তো নেই, এমনকি শহীদ মিনারের দিকে কেউই যাওয়ার চেষ্টাও করেননি, যা গত ৪৯ বছরে কখনোই ঘটেনি।
এ দিকে ফাঁকা নগরীতে দিনে এনে দিনে খাওয়া লোকজন পড়েছেন মহা দুশ্চিন্তায়। নগরীর চকবাজার মোড়ে ভোলার রিকশাচালক নাছিরের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। দুপুরের দিকে রিকশা নিয়ে বের হলেও যাত্রী পাচ্ছেন না তেমন। বিকেল পর্যন্ত আয় মাত্র ১৩০ টাকা। তাই কিভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে কুলকিনারা করতে পারছেন না নাছির। রিকশাচালক নাছিরের মতো নি¤œ আয়ের মানুষগুলো এখন নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহী এখন ফাঁকা নগরীতে পরিণত হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সর্বস্তরে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর রাজশাহী নগরীর এমন চিত্র দেখা গেছে। চিরচেনা রাজশাহীর সড়কে তেমন দেখা মিলছে না মানুষের। দুই-একজন মানুষ থাকলেও তারা প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছে না। এখন সড়কে নেই কয়েক দিন আগের মতো কলহ। যেন প্রাণহীন নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী। জীবিকার তাগিদে আসা মানুষগুলো ফিরে গেছে নাড়ির টানে বাড়ি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার এলাকায় এমন ফাঁকা দৃশ্য দেখা গেছে। শুধু সাহেব বাজারই নয়, নিউ মার্কেট, গোরহাঙ্গা, রেলগেট, ভদ্রা, তালাইমারীসহ বিভিন্ন জনবহুল এলাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে।
ময়মনসিংহ অফিস জানায়, ময়মনসিংহে মাস্ক পরা ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে কান ধরে উঠবস ও লাঠিপেটা করছেন। কোথাও মানুষের জটলা দেখলেই পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সচেতনতা সৃষ্টিতে পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামানের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সকাল থেকে মাঠে নামে। পুলিশি তৎপরতায় নগরীর অলিগলির দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। নগরীজুড়ে সেনাবাহিনীর টহল অব্যাহত ছিল। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জীবাণুনাশক পানি ছিটিয়ে নগরীর রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ময়মনসিংহ থেকে কোনো গণপরিবহন চলাচল করেনি। চা স্টলসহ দোকানপাট ও মার্কেট বন্ধ থাকায় সন্ধ্যার পর ভুতুরে নগরীতে পরিণত হয়। এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহে নতুন করে বিদেশফেরত ৩৭ জনসহ মোট ৭০০ জন প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। গতকাল আরো ৪৬ জনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement