২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উপকূলে বুলবুলের আঘাত

দুবলার চর লণ্ডভণ্ড, লালমোহনে ১২ বাড়ি বিধ্বস্ত, পটুয়াখালীতে ১, পশ্চিমবঙ্গে নিহত ২
ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর প্রভাবে গত রাতে ভোলার লালমোহনে ঝড়ো বাতাসে বেশ কয়েকটি ঘর বিধ্বস্ত ও গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে : নয়া দিগন্ত -

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের অগ্রবর্তী অংশ আঘাত হেনেছে সুন্দরবন ও এর আশপাশের এলাকায়। এই আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে সুন্দরবনের দক্ষিণে অবস্থিত দুবলার চরের অস্থায়ী শুঁটকিপল্লী। শনিবার রাতে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) দুবলারচর ভিএইচএফ স্টেশনের অপারেটর মো: কাশেম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর উপকূলে দুপুর ১২টা থেকে ঝড়ো হাওয়া শুরু হলেও শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের অগ্রবর্তী অংশ সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অংশে আঘাত হানতে শুরু করেছে। একই সাথে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ ফুট পানির উচ্চতা। এখন ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের অগ্রবর্তী অংশ সুন্দরবনের বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড, হিরণ পয়েন্ট, দুবলারচর, মেহের আলীর চর, অফিসকিল্লা, মাঝেরচর, আলোরকোল, মরণেরচরে আছড়ে পড়েছে। ১২০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে ঝড়ের তীব্রতা। তছনছ করে দিয়েছে দুবলারচরের অস্থায়ী শুঁটকিপল্লী।
ভোলা সংবাদদাতা জানিয়েছেন, জেলার লালমোহন থানার লর্ডহাডিং গ্রামে শনিবার রাত ১১টায় এক টর্নেডোর আঘাতে ১২টি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত ঘরে চাপা পড়ে ১০ জন আহত হয়েছেন। এলাকায় অনেক গাছ বাতাসের তীব্র আঘাতে উপড়ে পড়েছে। পটুয়াখালীতে বুলবুলের আঘাতে একজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে বুলবুলের আঘাতে দুইজন নিহত হওয়ার পাওয়া গেছে। ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বাতাসের গতি নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আঘাত হানে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল।
বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৯টায় ঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ উপকূলে চলে এসেছে বলে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির ব্যাস ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। ঝড়টি ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটার গতিতে উত্তরপূর্ব দিকে এগোচ্ছে। ঝড়ের প্রভাবে কলকাতা ও ওড়িষ্যায় দুইজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো।
পিটিআই জানিয়েছে, ঘর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় কলকাতায় বহু গাছ উপড়ে গেছে, নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কলকাতা শহরের একটি নামকরা ক্লাবে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ভারতের ওড়িষ্যায়ও ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার তথ্য দেয়া হয়েছে। এতে একজনের মৃত্যুর খবরও দিয়েছে তারা। ঝড়ের কারণে কলকাতা বিমাবন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। এর আগে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় থাকছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৯ নম্বর মহবিপদ সঙ্কেতের আওতায় থাকবে।
কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের আশঙ্কায় দেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বিরাজ করছে আতঙ্ক। সারা দেশের মানুষ এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করছেন।
প্রবল বাতাস, ভারী বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাস সাথে নিয়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের অগ্রবর্তী অংশ উপকূলে আছড়ে পড়েছে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকেই। বুলবুলের প্রভাবে সাগর হয় উত্তাল। বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে উপকূলে। সমুদ্রবন্দর
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে বুলবুল পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। মধ্যরাতের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনার সুন্দরবনের উপর দিয়ে এটি উপকূলে উঠে আসার কথা। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়টি পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানার পর কিছুটা শক্তি হারিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছার লক্ষণ স্পষ্ট।
ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে গতিবেগ প্রায় ২০ কিলোমিটার কমেছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোয় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস ছিল আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ও মুন ফেজের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নি¤œাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ছাড়া সব বিমানবন্দর সচল : এ দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাত হানার আশঙ্কায় চট্টগ্রামের হজরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ থাকলেও ঢাকার হজরত শাহজালাল, সিলেটের এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের সব বিমানবন্দর চালু থাকবে।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যার আগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম নয়া দিগন্তকে এ কথা জানান। তিনি বলেন, সিলেট এম এ জি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ফ্লাইট ওঠানামার কার্যক্রম থাকে না। তবে গত রাতে সিলেট বিমানবন্দরের কার্যক্রম চালু রাখা হবে। অভ্যন্তরীণ রুটের যশোর, সৈয়দপুর, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল সচল থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট সাধারণত রাতে চলে না। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। তারা বৈরী আবহাওয়ায় ফ্লাইট অপারেশন করবে কি না। এখন পর্যন্ত এর বাইরে আর কোনো তথ্য তার কাছে নেই বলে জানান তিনি।
পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ সতর্কতা : কলকাতা থেকে আমাদের সংবাদদাতা ফিরোজ আহমেদ জানান, বুলবুলের আঘাত হানার আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। মৎস্যজীবীদের গত পরশু রাতেই ফিরতে বলা হয় সমুদ্র থেকে। সমুদ্রের ধারে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে। সমুদ্রে ও সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চলেও মৎস্যজীবীদের মাছ ধরতে যেতে বারণ করা হয়েছে। সতর্কতা জারি করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে সব সমুদ্রতীরবর্তী যেসব পর্যটনস্থল রয়েছে যেমন দীঘা, মন্দারমনি, তালসারি শঙ্করপুর, বকখালী, সাগরদ্বীপে সমুদ্রের কাছাকাছি কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এসব পর্যটনস্থল আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে গেছে। কলকাতার রাস্তাঘাটও গতকাল ছিল অনেকটাই ফাঁকা।
এ দিকে ৭০-৮০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর এবং উড়িষ্যার কেন্দ্রপারা, জগৎসিংহপুর, ভদ্রক ও বালাসোরে।
ভোলা সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় ভোলায় আটটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬৬৮টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ কয়েক শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গঠন করা হয়েছে ৯২টি মেডিক্যাল টিম। জেলার অভ্যন্তরীণ সব নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার মধ্যে উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে নিরাপদে নিয়ে আসা হয়।
খাগড়াছড়ি সংবাদদাতা জানান, খাগড়াছড়িতে জরুরি প্রস্তুতি সভা করেছে জেলা প্রশাসন। এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে জেলায় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, পাহাড় ধসসহ জরুরি প্রয়োজনে সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাজ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঝালকাঠি সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ঝালকাঠিতে থেমে থেমে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। জেলার সুগন্ধা ও বিষখালীসহ অন্যান্য নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সব রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। জেলায় পাঁচটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সব স্কুলকলেজ খোলা রাখা হয়েছে সম্ভাব্য দুর্যোগে আশ্রয়ের জন্য।
পাথরঘাটা (বরগুনা) সংবাদদাতা জানান, ১০ নম্বর বিপদ সঙ্কেত জারির পরে উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), রেডক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সতর্ক অবস্থান রয়েছে।
মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, পায়রা নদীর মনোহরখালীর ফেরি চলাচল ও খেয়া বন্ধ রয়েছে। এ দিকে আয়লা-কানকি রামপুর বেড়িবাঁধের উপজেলার সুন্দ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন পায়রা নদীর বেড়িবাঁধের ২০০ ফুট বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানি বৃদ্ধি পেলে ওই এলাকার ৫ থেকে ৬টি গ্রামসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পিরোজপুর সংবাদদাতা জানান, পিরোজপুরেও কখনো হালকা আবার কখনো ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে ক্ষতির পরিমাণ যাতে কমিয়ে আনা যায় সে জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবু আলী মো: সাজ্জাদ হোসেন।
ভাণ্ডারিয়া (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় বিশেষ সতর্কতা জারি করাসহ সাতটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের সাধারণ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য উপজেলায় ৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মোট ৫৩টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
চিতলমারী (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, চিতলমারীতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে নি¤œআয়ের মানুষ। গত দুই দিনের বিরামহীন বৃষ্টিপাতে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ উপজেলায় ১৭টি সাইক্লোন শেল্টারসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
খুলনা ব্যুরো জানায়, এখানকার উপকূলের তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় প্রায় ৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পড়েছে ঝুঁকিতে। বাঁধ ভাঙার আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন উপকূলবাসী। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দুর্যোগ মোকাবেলায় খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।
সাতক্ষীরা সংবাদদাতা জানান, উপকূলে বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি কমানো ও জানমালের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সাথে সেনাবাহিনীও উপকূলীয় এলাকায় কাজ করবে। গতকাল শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত সাতক্ষীরা উপকূলের এক লাখ দুই হাজার মানুষকে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্যের একটি টিম উপকূলীয় এলাকায় নিয়োজিত করা হয়েছে।
পটুয়াখালী সংবাদদাতা জানান, পটুয়াখালীর আশ্রয়কেন্দ্রে ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
রাঙ্গাবালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মাশফাকুর রহমান জানান, আগুনমুখা নদীতে এ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে মাছ শিকাররত কমপক্ষে ৫০টি মাছ ধরা নৌকার জেলেদেরকে নদী থেকে জোর করে উঠিয়ে দিয়েছেন তারা।
চাঁদপুর সংবাদদাতা জানান, চাঁদপুর থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুর। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুরের বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
বরগুনা সংবাদদাতা জানান, বরগুনা সদরের নলটোনা এলাকায় বিষখালী নদীর পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বরগুনার ছয় উপজেলার বেড়িবাঁধের বাইরে ও ভেতরের বাসিন্দারা গতকাল সকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে শুরু করেন।
আমতলী (বরগুনা) সংবাদদাতা জানান, আমতলী-তালতলী উপজেলায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ১২২টি সাইক্লোন শেল্টার। আমতলী পৌরসভাসহ উপজেলায় ৭৩টি ও তালতলী উপজেলায় ৪৯টি সাইক্লোন শেল্টারের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্যালয়ও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনার উপকূলীয় চার উপজেলা দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার মানুষ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল সকাল ১০টার পর থেকেই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ লোকেরা জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে যাওয়া শুরু করেন। খুলনায় এ দুর্যোগ মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গত শুক্রবার বিকেল থেকেই প্রস্তুত রাখা হয় ৩৪৯টি সাইক্লোন শেল্টার। এসব শেল্টারে প্রায় ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৫০ জনকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি।
গত শুক্রবার বিকেলে খুলনা সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন। জেলা প্রশাসক জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় খুলনা জেলা প্রশাসন সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। খুলনা জেলার ৩৪৯টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও ৯টি উপজেলায় ১০টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
অপরপক্ষে খুলনা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত শুক্রবার বিকেলে নগর ভবনের জিআইজেড মিলনায়তনে মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় কেসিসির জরুরি সেবা কাজে নিয়োজিত বিভাগগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল, দুর্যোগ বিষয়ে নগরবাসীকে সচেতন করার জন্য মাইকিং, স্কুল-কলেজের ভবনগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা, মেডিক্যাল টিম গঠন, অ্যাম্বুলেন্স-ফায়ার সার্ভিসসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত বিভাগগুলো প্রস্তুত রাখা, জরুরি ত্রাণসামগ্রী ও শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত খুলনায় ৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ইতোমধ্যে সুন্দরবনের দুবলারচর থেকে সব টুরিস্টকে ফেরত এবং স্থানীয় জেলেদের কোস্টগার্ডের সিসিএমসিতে আশ্রয় দিয়েছে। সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার গোলাখালীগ্রাম থেকে ৬৫০ জন নারী-পুরুষকে নিরাপদে আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মংলা চ্যানেলে অবস্থানকারী সব কোস্টার এবং লাইটারকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো হয়েছে। কোস্টগার্ডের ১০টি অপারেশনাল জাহাজ সাইক্লোন পরবর্তী উদ্ধারকাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
এ দিকে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের স্বাভাবিক কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে।
পাইকগাছা (খুলনা) সংবাদদাতা জানান, খুলনার পাইকগাছা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ৩৬টি সাইক্লোন শেল্টারের পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে খোলা রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে স্কাউট, গার্লস গাইডসহ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সদস্যদের। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে সব দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের জেটিগুলো জাহাজশূন্য করার পাশাপাশি সব ধরনের অপারেশনাল কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা হয়েছে। গতকাল বিকেল ৪টার পর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইট অপারেশনও বন্ধ করা হয়। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে কয়েক শ’ লাইটার জাহাজসহ ফিশিং ট্রলার ও মাছ ধরার নৌকা।
এ দিকে গতকাল বিকেল ৪টার পর বন্ধ করা হয় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অপারেশনাল কর্মকাণ্ড। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সরোয়ার-ই-জামান নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি থেকে রায় গতকাল বিকেল ৪টা থেকে ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ রাখা হয়েছে। বিমানবন্দরের ইকুইপমেন্টগুলো গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিবহন পুলের গাড়ি এবং অগ্নিনির্বাপণকারী গাড়িগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা।
চট্টগ্রাম বিভাগে এক হাজার ২২৮টি এবং চট্টগ্রাম জেলায় ২৮৪টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে সরকারি সব দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি ছুটি বাতিলসহ কর্মস্থলে থাকা নিশ্চিত করা হয়েছে।
কক্সবাজার (দক্ষিণ) সংবাদদাতা জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর প্রভাব নিয়ে উপকূলে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে আটকা পড়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ পর্যটক। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে কক্সবাজারের উপকূলের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলা কক্সবাজারে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৯৭টি মেডিক্যাল টিম ও ছয় হাজার ৪৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক। সাগর উত্তাল থাকায় শুক্রবার থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। বুলবুলের তীব্রতা শুরু হলে উখিয়া- টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ভূমিধস ও ঝুপড়ি ঘরগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বুলবুলের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি রোধে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় এসব কথা জানানো হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: কামাল হোসেন জানিয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় কক্সবাজারে ৯৭টি মেডিক্যাল টিম ও ৬ হাজার ৪৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সতর্ক অবস্থায় রাখতে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement