২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

৫০ বছরে ৯টি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত নভেম্বরে

-

নভেম্বর মাস এলেই উপকূলীয় জনগণের ঝড় জলোচ্ছ্বাসে সর্বস্ব হারানোর আতঙ্ক জেগে ওঠে। আবারো এই নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ শক্তি সঞ্চয় করে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ ও গড়ে ওঠা সভ্যতা। ১৯৭০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে শুধু এই নভেম্বর মাসেই ৯টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি, গৃহপালিত ও বন্যপশুর মৃত্যু ও স¤পদ হানি ঘটে। তাই উপকূলবাসীর মধ্যে নভেম্বর আলাদা একটি আতঙ্কের মাস। চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে দুই থেকে তিনটি নি¤œচাপের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। সম্প্রতি বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটির নিয়মিত বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়। ঢাকায় আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক, চেয়ারম্যান ও বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক শাহ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
আবহাওয়া দফতর সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের ১২-১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণ ও স¤পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মকসহ ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। হারিকেনের তীব্রতা নিয়ে প্রচণ্ড বাতাস দুই দিন ধরে বার বার আঘাত হানে চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহান উদ্দিনের উত্তরাঞ্চল, চর তজুমুদ্দিন, মাইজদির দক্ষিণাঞ্চল ও হরিণাঘাটায়।
স্মরণকালের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক এই ঘূর্ণিঝড়ে জীবন, স¤পদ ও ফসলের ধ্বংস হয়। বিধ্বস্ত হয় জনপদ। বিলীন হয় গড়ে ওঠা সভ্যতা। সরকারি হিসেবে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এই তাণ্ডবে।
এর মধ্যে ৪৬ হাজার মৎস্যজীবী ঘূর্ণিঝড় চলাকালে মাছ ধরার সময় মৃত্যুবরণ করে। মোট ২০ হাজারের অধিক মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। স¤পদ ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণও ছিল অনেক। ১০ লাখেরও অধিক গবাদিপশুর মারা যায়, চার লাখ ঘরবাড়ি এবং সাড়ে তিন হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভয়ানকভাবে ক্ষতিগস্ত হয়।
১৯৭০ সালের এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মি.। সমুদ্রে ভরা জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি সংগঠিত হওয়ায় এমন প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৫-৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। অসংখ্য মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
একই বছরের ২৮-৩০ নভেম্বর সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ৯৭-১১৩ কিমি. বায়ু প্রবাহ ও ১ মি. কম উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসসহ ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। সমগ্র খুলনা অঞ্চলে ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করে এবং খুলনা শহরের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয় এবং ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৯৭৪ সালের ২৪-২৮ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপসমূহে ঘণ্টায় ১৬১ কিমি. বেগে তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও -৫.২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। প্রায় ২০০ মানুষ ও এক হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয় এবং দুই হাজার ৩০০ ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়।
১৯৮৩ সালের ৫-৬ নভেম্বর ঘণ্টায় ১৩৬ কি.মি. বাতাসের বেগে ও ১.৫২ মি. উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, কুতুবদিয়ার সন্নিকটস্থ কক্সবাজার উপকূল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের নি¤œাঞ্চল, টেকনাফ, উখিয়া, সোনাদিয়া, বরিশাল ও পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ৫০টি নৌকাসহ তিনশত মৎস্যজীবী নিখোঁজ হন এবং দুই হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
১৯৮৬ সালের ৮-৯ নভেম্বর উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়। বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রতিঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১০ কিমি. এবং খুলনায় ৯০ কিমি.। এতে ১৪ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৯৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৮৮ সালের ২৪-৩০ নভেম্বর যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং খুলনা বরিশালের চরাঞ্চলের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কিমি. বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মংলায় চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে পাঁচ হাজার ৭০৮ ব্যক্তি নিহত হন এবং ৬৫ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। বহু সংখ্যক বন্যপশু মারা যায়। তার মধ্যে ছিল হরিণ ১৫ হাজার ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯টি এবং ফসল নষ্ট হয় প্রায় ৯৪১ কোটি টাকার।
১৯৯৫ সালের ২১-২৫ নভেম্বর উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহে এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিমি. বেগে বাতাসের গতিতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যু ও ১৭ হাজার গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হানে। বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলা এই সাইক্লোনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অন্যন্য জেলাগুলো হচ্ছেÑ ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, শরিতপুর, বরিশাল ও ভোলা।
সরকারি হিসাবে সাইক্লোন সিডরের কারণে ৩ হাজার ৪০৬ জন লোক নিহত হয়, নিখোঁজ হয় এক হাজার তিনজন, মারাত্মক আহত হন ৫৫ হাজার। তবে বেসরকা-রি হিসাবে এ সংখ্য আরো বেশি।
দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করছে উন্নয়ন সংগঠন ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন অফ কোস্টাল এরিয়াস পিপ’স (ডোক্যাপ)। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক মাসুদ আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, বিগত বছরগুলোর ঘূর্ণিঝড়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উপকূলবাসীর জন্য নভেম্বর একটি আতঙ্কের মাস। কেননা দেশের ইতিহাসে সব বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এই নভেম্বর মাসেই সংগঠিত হয়। তিনি আরো বলেন, সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ দুর্যোগ মোকাবেলায় ও ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে উপকূলবাসীকে বাঁচাতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement