১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বশেমুরবিপ্রবি ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা ভিসির মদদপুষ্ট বাহিনীর হামলায় রক্তাক্ত শিক্ষার্থীরা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা; ইনসেটে হামলায় আহত এক শিক্ষার্থী হ নয়া দিগন্ত -

গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদত্যাগের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আজ রোববার ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করেছে। এ ঘটনায় ভিসি পেটোয়া বাহিনীর হামলায় এক ছাত্রীসহ অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গোবরা, সোনাকুড়, নবীনবাগ এলাকায় হামলার ঘটনাটি ঘটে। আহত অন্তত ১০ শিক্ষার্থীকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হামলার খবর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়লে উত্তাল হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে, জয় বাংলা চত্বর, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ ঘটনায় বিভিন্ন স্থানে র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. নূরউদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৪৪ ধারা জারি করার জন্য জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয়সংখ্যক পুলিশ মোতায়নের জন্য পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত জরুরি পরিস্থিতিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত রাখাসহ সম্ভাব্য সব অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের মৌখিক অনুমতির পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন পূজার নির্ধারিত ছুটির সাথে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে। চিঠিতে হলের শিক্ষার্থীদের শনিবার সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হলেও কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা মেনে না নিয়ে আন্দোলন আরো বেগবান রেখেছে।
গত বুধবার রাত থেকে শিক্ষার্থীরা ভিসি অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
আন্দোলনরত আহত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে জানান, শুক্রবার রাত থেকে হলে খাবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে হলে বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসহ সব প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য মতে, দুর্নীতিবাজ, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্যকারী ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক টর্চার সেলে পরিণত করেছে। শিক্ষার্থীরা এই ভিসির পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলনরত আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ও মূল ফটকের বাইরে অবস্থান নিয়ে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে।
উল্লেখ্য, গত ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও দ্য ডেইলি সানের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্যায়ভাবে সাময়িক বহিষ্কার করে। পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের তীব্র আন্দোলনের মুখে জিনিয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ একটা রাজনৈতিক মহলের চক্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে রাজনৈতিক মহলের ভিসিবিরোধী একটা চক্রান্ত যেটা ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ করা যাচ্ছে। তিনি মোবাইলে বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর কে বা কারা হামলা করেছে আমার জানা নেই। ক্যাম্পাসে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যদি আন্দোলনকারীরা না যায় তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার বিষয়টি আমার জানা নেই।
এ দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে জানান, গোপালগঞ্জ শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে ভিসি সমর্থকরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গোবরাসহ বিভিন্ন স্থানে মারধর করেছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসহ সব প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আরো জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা শহর থেকে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় নীলার মাঠ এলাকায় ভিসির পেটোয়া বাহিনী হামলা চালায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় আশপাশে ক্যাম্পাসের বাইরে বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা চালায় পেটোয়া বাহিনী। এ সময় অনেক শিক্ষার্থীকেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বিল পাড়ি দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেখা গেছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য দেশী অস্ত্রশস্ত্রের নিয়ে মহড়া দেয় ওই বাহিনী। এতে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনালে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে পেটোয়া বাহিনীর মহড়া ও রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে অনেক আহত শিক্ষার্থীকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনার খবর পেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা শহর থেকে ক্যাম্পাসে যেতে পুলিশি বাধায় সার্কিট হাউজের সামনের সড়ক এবং গোবরা-সোবাহান সড়কে অবস্থান নিয়ে ভিসিকে অপসারণের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে।
দুর্নীতিবাজ, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্যকারী ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক টর্চার সেলে পরিণত করেছে।
উৎকণ্ঠা উত্তেজনা ও আশঙ্কার মধ্যেও আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নিয়ে ভিসিবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, ১৪৪ ধারা জারি করতে হবে। তবে ভিসি আমাকে ১৪৪ ধারা জারির জন্য অনুরোধ করেছেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান এ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি।
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ
রাবি সংবাদদাতা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ভিসি ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) কর্মরত সাংবাদিকেরা। শনিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে তারা এ কর্মসূচি পালন করেন।
জানা গেছে, গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টায় রাবি সাংবাদিকরা প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়ে সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় ভিসি নাসির উদ্দিনের পদত্যাগ দাবি করে সাংবাদিকরা সেøাগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভকালে তারা ‘সাংবাদিকের উপর হামলা কেন’, ‘ভিসি নাসির উদ্দিনের পদত্যাগ চাই’, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা কেন’সংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
কর্মসূচির শুরুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত মতিহার থানা পুলিশ কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। তবে থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, সাংবাদিকেরা বশেমুরবিপ্রবি ভিসির পদত্যাগের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছিল। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সড়ক অবরোধ করলে সাধারণ মানুষের চলাচলে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। তাই তাদের বলা হয়েছিল ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে কর্মসূচি পালন করতে।
প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সড়ক অবরোধের পর সাংবাদিকেরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলটি প্রধান ফটকের সামনে থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করেন সাংবাদিকেরা।
সাংবাদিক নেতারা বলেন, বশেমুরবিপ্রবিতে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। কয়েকদিন আগে তুচ্ছ ঘটনায় সাংবাদিক জিনিয়াকেও বহিষ্কার করা হয়। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে তার বিরুদ্ধে আড়াই কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে এই ভিসি স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাচ্ছে। একজন শিক্ষকের আচরণ এমন হলে শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে কী শিখবে? এ সময় তারা ভিসি দ্রুত পদত্যাগ দাবি করেন। অন্যথায় বৃহৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেন সাংবাদিকেরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর লুৎফর রহমান বলেন, সাংবাদিকেরা কর্মসূচি পালন করবে আমাকে জানিয়েছিল। সেখানে যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলাম।


আরো সংবাদ



premium cement