২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ডেঙ্গুতে আরো ৭ মৃত্যু

নতুন আক্রান্ত ১৬১৫ : আর না বাড়ার আশা স্বাস্থ্য অধিদফতরের
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক শিশুর চিকিৎসা চলছে : নয়া দিগন্ত -

দেশের কয়েক স্থানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, ঢাকা, খুলনা ও জামালপুরে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তবে তিন দিন ধরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমছে। গতকাল দুপুরের পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৬১৫ জন। আগের দিনের তুলনায় গতকাল সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে ৫ শতাংশ। গত রোববার ছিল এক হাজার ৭০৬ জন। সারা দেশের হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছে ছয় হাজার ৭৩৩ জন। গত শনিবার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪৬০ জন এবং গত শুক্রবার ওই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৭২১ জন। চলতি আগস্টের ১৯ দিনে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৩৬ হাজার ৩৩৬ জন। সরকারি হিসাবে আগস্টের এই ১৯ দিনে ডেঙ্গু ভাইরাসে মারা গেছেন ১০ জন। জুলাই মাসে মারা যান ২৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা গতকাল বিকেলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই কমছে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে আর বাড়বে না। তিনি জানান, বর্তমানে যে ধারায় আক্রান্তের সংখ্যা কমছে তা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় আগের তুলনায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত কমেছে ৭ শতাংশ এবং রাজধানীর বাইরে কমেছে ৫ শতাংশ। কেন কমছে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত প্রচেষ্টা ও জনসচেতনতার কারণে কমছে। ব্যাপক প্রচারণা এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে ডেঙ্গু প্রজননস্থল ধ্বংসে কাজ করার কারণে আগের তুলনায় ডেঙ্গু কিছুটা কমেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে আরো উপস্থিত ছিলেন হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা: আয়েশা আক্তার, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়াবিষয়ক প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা: এম এম আক্তারুজ্জামান।
এ দিকে গতকালও রাজধানীর হাসপাতালের তুলনায় ঢাকার বাইরে সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল। গতকাল রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি ৪১ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ৭৩৪ জন এবং বাইরের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯৭২ জন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায় (রোববার দুপুর ১২টার পূর্বের ২৪ ঘণ্টা) ১২২ জন। মিটফোর্ড হাসপাতালে ৮১ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২৪ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৭৫ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ জন, পুলিশ হাসপাতালে ১৮ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৭৩ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৫৪ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১৪ জন, বিজিবি হাসপাতালে পাঁচজন। এ ছাড়া সরকারি হিসাবে রাজধানীর বাইরে ঢাকা বিভাগে ২১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫২ জন, খুলনা বিভাগে ১৪৫ জন, রাজশাহী বিভাগে ৯৫ জন, রংপুর বিভাগে ৩১ জন, বরিশাল বিভাগে ১৫৫ জন, সিলেট বিভাগে ১৫ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ময়মনসিংহে আরো ২ জনের মৃত্যু
ময়মনসিংহ অফিস জানায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরো দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল চারজনে। এরা সবাই কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা সদর হাসপাতাল থেকে জ্বর নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ গত রোববার রাত ১টার দিকে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার আবদুল লতিফের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৪০) এবং গতকাল সোমবার দুপুর ১টার দিকে দুর্গাপুর উপজেলার ব্যবসায়ী সেলিম (২৭) ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে মারা যান। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা: এ বি এম সামসুজ্জামান জানান, রোববার বিকেলে আনোয়ার হোসেন নেত্রকোনা সদর হাসপাতাল থেকে এসে ভর্তি হয়। আনোয়ার হোসেন কেন্দুয়ার আবদুল লতিফের ছেলে। তবে দুর্গাপুরের সেলিম ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আইইডিসিআরে পরীক্ষার প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ দিকে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ঈদের পর থেকে কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৬ জন ভর্তি হন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ১৭৪ জন। গত ২১ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত এই হাসপাতালে ভর্তি হন এক হাজার ৬০ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮৮৩ জন।
খুলনায় পঞ্চম মৃত্যু
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় ডেঙ্গুতে মিজানুর রহমান (৪০) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ৭টায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা: শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ নিয়ে খুলনায় ডেঙ্গুতে মোট পাঁচজনের মৃত্যু হলো।
মিজানুর পেশায় সবজি বিক্রেতা ছিলেন। গত ১৫ আগস্ট তিনি ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে খুমেক হাসপাতালে ভর্তি হথন। তার বাড়ি রূপসা উপজেলার খাঁজাডাঙ্গা গ্রামে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। খুলনার সিভিল সার্জন ডা: এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, খুলনায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৫৭৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৮৯ জন এবং গতকাল ২০ জন ভর্তি হয়েছে। বাকিরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
ফরিদপুরে আরেক জনের মৃত্যু
ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক মসজিদের খাদেম মারা গেছেন। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মারা যাওয়া ওই রোগীর নাম শেখ মো: দেলোয়ার হোসেন (৩৫)। তিনি ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের গোলডাঙ্গীচর এলাকার শেখ শফিউদ্দিনের ছেলে। শহরের পূর্বখাবাসপুর মসজিদের খাদেম হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। জানা যায়, চার দিন আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেলোয়ার ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। গত রোববার তাকে সদর হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দিলে সন্ধ্যার দিকে তিনি পূর্ব খাবাসপুরের বাসায় যান। সেখানে রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, দেলোয়ার গত ১৮ আগস্ট সদর হাসপাতাল থেকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হন। এ দিকে, দেলোয়ার শেখকে দিয়ে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছয় রোগীর মৃত্যু হলো। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো ৫৭ জন ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে মোট ভর্তি রয়েছেন ৩৪৬ রোগী।
বাবার সাথে ঢাকায় ঈদ করতে এসে প্রাণ গেল মাসরুফার
হরিপুর (ঠাকুরগাঁও) সংবাদদাতা জানান, বাবার সাথে ঈদ করতে ঢাকায় গিয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হরিপুর উপজেলার গেদুড়া ইউনিয়নের বরুয়াল (ধনসোড়া) গ্রামের মোস্তফার মেয়ে মাসরুফা (১০) লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল। গতকাল সোমবার সকাল ৬টায় শিশুটি রাজধানীতে মারা যায়। মোস্তফা জানান, গত তিন বছর ধরে আমি ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করি। এবার পরিবারের সবাই মিলে একসাথে ঈদ উদযাপন করার জন্য আমার স্ত্রী মাজেরা ঈদের কয়েক দিন আগে তিন কন্যাসন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসে। মাসরুফা অসুস্থ হলে ১৪ আগস্ট চিকিৎসার জন্য রামপুরা বনশ্রীর অ্যাডভান্স হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালের ডাক্তার কামরুল হাসান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বলেন, মাসরুফা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এরপর তিনি দুই দিনের ওষুধ দিয়ে ১৯ আগস্ট আবার হাসপাতালে আসতে বলেন। কিন্তু আবার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগেই আমার মেয়ে সোমবার ভোর ৬টার দিকে মারা গেছে। হরিপুরের গেদুড়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাসরুফার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জামালপুরে ২ জনের মৃত্যু
জামালপুর ও দেওয়ানগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জামালপুর শহরের হাটচন্দ্র এলাকার রাজমিস্ত্রি হামিদুল ইসলাম রাজু (৩৫) ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং একই হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর জেলার দেওয়ানগঞ্জের বৃষ্টি আক্তার (২৫) নামে এক গার্মেন্টসকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। গত রোববার ঘটনা দু’টি ঘটে। হামিদুল জামালপুর শহরের হাটচন্দ্রা উত্তরপাড়া এলাকার ইকবাল হোসেনের ছেলে। অন্য দিকে বৃষ্টি আক্তার দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার চিকাজানী আকন্দপাড়া গ্রামের লাল মিয়ার মেয়ে এবং ঢাকায় একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন। হামিদুলের খালাতো ভাই সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, জ্বরে আক্রান্ত হলে শনিবার তাকে স্থানীয় নকিব উদ্দিন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করানো হয়। পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে ওই দিনই তাকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। ওই রাতে রাজুকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো হয়। রোববার বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে সেখানে তার মৃত্যু হয়। অপর দিকে বৃষ্টির মা ছমিনা বেগম জানিয়েছেন, সে ঢাকায় জ্বরে আক্রান্ত হলে ১০ আগস্ট তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরদিন দেওয়ানগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বৃষ্টির ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। ওই দিনই তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসা শেষে শনিবার রাতে তাকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। রোববার ভোর ৬টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাক্তার প্রফুল্ল কুমার সাহা বলেন, শহরের চন্দ্রার হামিদুল শনিবার রাতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন কিনা তা জানা নেই। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে অনেক সময় জরুরি বিভাগ থেকেই রোগীর স্বজনরা ময়মনসিংহে নেন। জামালপুরের সিভিল সার্জন ডাক্তার গৌতম রায় বলেন, বৃষ্টি নামে এক নারীর ডেঙ্গুজ্বর শনাক্ত হয়েছিল। স্বজনরা তাকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।


আরো সংবাদ



premium cement