১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৩৫৪০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি

নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা বিষয়ে ঘোষণা দাবি
-

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি মিয়ানমারের রেডিও টেলিভিশনে ঘোষণা দিলেই রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যাবে। তাছাড়া আকিয়াবের আশ্রয় শিবিরে অবস্থানরত প্রায় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফেরার সুযোগ দেয়া এবং তারা স্বেচ্ছায় ফিরে গেলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা দলে দলে রাখাইনে ফিরে যাবে বলে মত দিয়েছেন রোহিঙ্গারা। গতকাল সোমবার জাতিসঙ্ঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে কাউন্সিলিং করতে গেলে রোহিঙ্গারা এমন কথা বলেছেন তারা। রোহিঙ্গাদের সাথে গতকাল সারা দিন ২২ আগস্টের প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলেন, এই দুই সংস্থার কর্মকর্তা। এ সময় রোহিঙ্গা নেতারা সবাই প্রায় একই কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সুরাহা আগে হতে হবে। জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে এবং বাড়িঘর ফিরিয়ে দিয়ে দেশের নাগরিক হিসেবে চলাচলের অধিকার প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান করলেই তারা ফিরে যাবেন। তারা মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ বসতভিটা ছাড়া কোনো ধরনের আশ্রয় শিবিরে থাকতে রাজি নন। গতকাল সারা দিন ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে উখিয়া টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের মুখে মুখে চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। মুছনি ক্যাম্পের (ক্যাম্প নং-২৬) হেড মাঝি মোহাম্মদ জাফর জানান, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। আমরা বলেছি রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা বার্মার রেডিও টেলিভিশনে আগে দেয়া হোক। সে ঘোষণা বিশ্ববাসী শুনবে, রোহিঙ্গারা শুনবে। তারপর তাদের জানমাল এবং ইজ্জতের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হলে অর্থাৎ পরিবেশ সৃষ্টি করা হলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে বলতে হবে না। তারা এমনিতেই ফিরে যাবে। বালুখালী শিবিরের হেড মাঝি জাকির হোসেন জানান, সম্প্রতি সফরের সময় মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল উখিয়ায় কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি তিন দফা মানার ঘোষণা না দিলে কোনো রোহিঙ্গা রাখাইন ফিরে যাবে না। দাবিগুলো হচ্ছেÑ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, রাখাইন রাজ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ এবং ফেলে আসা সহায় সম্পত্তি বাড়িঘর ফেরত দিতে হবে। কিন্তু এসব দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কোনো সুরাহা ছাড়া হঠাৎ প্রত্যাবাসন ঘোষণায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভয় দেখা দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রত্যাবাসন শুরু হোক সেটা সবাই চাই কিন্তু মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে কোনো আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে থাকতে রাজি নন তারা। থাইংখালীর তাজিম্মাখোলার (ক্যাম্প নং ১৩) মাঝি মোহাম্মদ আলী জানান, অন্য কওম (জাতি) যেভাবে রাখাইনে চলাফেরা করে রোহিঙ্গাদেরও সেভাবে চলাচলের স্বাধীনতা দিতে হবে। আমরা এনভিসি চাই না, চাই আমাদের নাগরিক অধিকার পুনর্বহাল। আলীখালী (ক্যাম্প ২৫) এর মাঝি রহিম উল্লাহ জানান, নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমার যদি রাজি হয় তাহলে তারা আকিয়াবের আশ্রয় শিবিরে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমাদের আগে দিক এবং তারা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যাক। এরকম হলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য কাউকে বলতে হবে না। তারা এমনিতেই ফিরে যাবে রাখাইনে। জাদিমোরা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হোক, সেটা আমরা চাই। তবে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচার ও নিজ দেশে নাগরিকত্ব দিলে ফেরত যেতে প্রস্তুত। হঠাৎ করে প্রত্যাবাসনের খবরে রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন। কিভাবে কী হচ্ছে, তা আমরা বুঝতে পারছি না। বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা সানজিদা আক্তার (৩৪) জানান, ২০১৭ সালের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে সেখানকার সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে তার স্বামীকে। ছোট এক বোনকে ধর্ষণ করেছে। আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে বসতিতে। এখন সেই বসতির কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। সানজিদা বলেন, আমরা রাখাইনে গিয়ে আরেক শরণার্থী জীবন চাই না। নাগরিক স্বীকৃতি পেলেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেব। এদিকে ২২ আগস্ট কারা রাখাইনে ফিরে যাচ্ছে তার তালিকা এখনো জানা না গেলেও সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর জোর প্রস্তুতি চলছে। এ জন্য কাজ করছে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনএইচসিআর’ এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়। যেসব শরণার্থী ফিরে যেতে রাজি হবেন তাদের টেকনাফের কেরুনতলী ও নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তের প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে নেয়া হবে। সেখান থেকেই তাদের পাঠানো হবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। তবে জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হবে না কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ভণ্ডুল এবং প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে কোনো মহলের উসকানি কঠোর হস্তে দমন করা হবে। প্রত্যাবাসনের জন্য গতকাল সোমবারও টেকনাফের নাফ নদীর তীরে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের কেরনতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাটটিতে কাজ চলছিল। চার দিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা এই ঘাটে প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি করা হয়েছে টিনের তৈরি আধাপাকা ৩৩ কক্ষের বিশাল ঘর। প্রত্যাবাসন ঘাটের দায়িত্বে থাকা প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের মোহাম্মদ শহিদুল হাসান জানান, এ ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা রয়েছে। তাই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এখানে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন কাজকর্ম চলছে। ২২ আগস্টের প্রত্যাবাসন বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে আপাতত কিছু বলা যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় বাংলাদেশে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ওই দিন আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাবাসন ভণ্ডুল হয়। এদিকে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ স্বতন্ত্র তদন্ত টিমটি ইতোমধ্যে কক্সবাজার পৌঁছেছে। প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গার সাক্ষ্য নেয়ার কথা রয়েছে তাদের। তবে এসব রোহিঙ্গা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আশ্বাস না পেলে সাক্ষ্য দেবে না বলে মনে করা হচ্ছে। কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আশ্বাস না পেলে কক্সবাজারে সফরে আসা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ টিমের পক্ষে সাক্ষ্য নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য বৈঠকে আমরা প্রতিনিধিদলকে বলেছি যে, সাক্ষ্য দেয়া রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা। বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করা হবে বলে প্রতিনিধিদলও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement