২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

নদীতে বিলীন গ্রাম-বাজার

ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার
শরীয়তপুরে পদ্মার ভাঙনে এভাবেই বিলীন হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা : নয়া দিগন্ত -

দেশের বিভিন্ন জেলায় নদীভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও রাজবাড়ী জেলায় যমুনা ও পদ্মার ভাঙনে বসতবাড়ি, বাজার ও সরকারি ভবনসহ অনেক স্থাপনা নদীতে বিলীন হচ্ছে। শত শত পরিবার ঘরবাড়ী ও সহায়-সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। যমুনার সর্বগ্রাসী থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলা। পদ্মা-যমুনার ভাঙনে দিশেহারা লোকজন তাদের এ দুরবস্থার জন্য অপরিকল্পিত নদী খনন ও ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা নিয়ে দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন। এ দিকে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা অববাহিকায় হুহু করে বাড়ছে পানি, ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন কয়েকটি জেলার মানুষ।
শরীয়তপুর সংবাদদাতা জানান, পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে প্রতিদিনই নদীতে বিলীন হচ্ছে জেলার নড়িয়া উপজেলার সরকারি বেসরকারি ভবন, মূলফৎগঞ্জ বাজারের বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ এলাকার বহু লোকের সাজানো গোছানো ঘরবাড়ি।
গত সোমবার রাতে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনটির বেশির ভাগ নদীতে চলে গেছে। হাসপাতাল ক্যাম্পাসের একটি আবাসিক ভবনে জরুরি বিভাগ ও বহিঃবিভাগ চালু রাখা হলেও হাসপাতালে প্রবেশের সড়কটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় ভয়ে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন না। ফলে এ উপজেলার তিন লক্ষাধিক লোকের স্বাস্থ্যসেবা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এ উপজেলার চরাঞ্চলের পাঁচটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক পরিবারের নারী ও শিশু রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় লোকজন দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্যত্র হাসপাতালের কার্যক্রম চালু করার দাবি জানিয়েছেন।
এ দিকে নদীভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরো ১১টি ভবন। এ ছাড়া গত তিন দিনে মূলফৎগঞ্জ বাজার ও আশপাশের এলাকার অর্ধশতাধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও অন্তত ৪০টি বাড়ি ঘর পদ্মায় চলে গেছে। এর আগে মূলফৎগঞ্জ বাজারের দুই শতাধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সীমানা প্রাচীর, মসজিদ, গ্যারেজ ও একটি মন্দির বিলীন হয়ে গেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী তিন মাসে নড়িয়া উপজেলার অন্তত সাড়ে চার হাজারের বেশি মানুষের ফসলি জমি, বাপ-দাদার কবর, বাড়িঘর ও বহুতল ভবনসহ অনেক স্থাপনা পদ্মায় বিলীন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই খোলা আকাশের নিচে, আবার কেউ রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে খুপরি ঘর তোলে কোনো মতে মাথা গুঁজে আছেন। রাক্ষসী পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে তাদের দিন কাটছে আজ সীমাহীন কষ্টে আর চোখের পানিতে।
সরেজমিন দেখা যায়, নড়িয়া হাসপাতালের নতুন ভবনটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে বেশির ভাগই পদ্মায় পড়ে গেছে। পাশের ভবনগুলো নদীর তীরে রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও কোনো রোগী দেখা যায়নি। হাসপাতালের সামনে দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বালুভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা বসত বাড়ি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। বাজারের পাকা দোকানগুলোর মালিকেরা সেগুলো ভেঙে ইট ও রড সরিয়ে নিচ্ছেন।
কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়াম্যান ক্ষতিগ্রস্ত ঈমাম হোসেন দেওয়ান বলেন, আমরা খুবই অসহায়। আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। হাসপাতালটি ভাঙনের মুখে পড়ায় এ উপজেলার লোকজনের চিকিৎসা সেবা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমরা সরকারের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বে হাসপাতালের কার্যক্রম চালু রাখার দাবি জানাচ্ছি।
নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুনীর আহমেদ বলেন, সোমবার রাতে হাসপাতালের নতুন ভবনটির বেশির ভাগ পদ্মায় চলে গেছে। আমরা ভবনটি নিলামে বিক্রির জন্য মাইকিং করলেও কোনো লোক আসেনি কেনার জন্য। হাসপাতালের আরো ১১টি ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে। সীমিত পরিসরে জরুরি ও বহিঃবিভাগের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। তবে এখনো হাসপাতালের কার্যক্রম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াছমিন বলেন, ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকায় হাসপাতালের কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চালু রাখা হয়েছে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। নদীভাঙন পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের পাটাগ্রাম গ্রামের বৃদ্ধা বুলবুলি বেগমের দীর্ঘশ্বাস আর বোবাকান্না যেন আর থামে না। যমুনাকে দেখিয়ে তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, ‘ওই আমারে সর্বনাশ করেছে। বসতঘর, ফসলি জমি সব কিছু গ্রাস করেছে।’ তিনি গত ২ সেপ্টেম্বর তার ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল হারিয়ে আজ নিঃস্ব। অথচ এক সময় তিনি সম্পদশালী গৃহস্থ ঘরের বউ ছিলেন। যমুনার করাল গ্রাসে সব হারিয়ে ওই বৃদ্ধা এখন আশ্রয় নিয়েছেন পাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। যমুনার ভাঙনে আজ গৃহহারা হাজারও মানুষ।
যমুনার সর্বগ্রাসী থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে কাজিপুর সদর, মাইজবাড়ী, গান্ধাইল ও শুভগাছা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। এ ছাড়া খাসরাজবাড়ী, নাটুয়ারপাড়া, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিশ ও মনসুর নগর ইউনিয়নের অনেক গ্রাম তীব্র ভাঙনের শিকার। ১৯৫৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাজিপুরে ভাঙন প্রতিরোধে ছোট-বড় অনেক পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দের কোটি কোটি টাকার বড় অংশই ঠিকাদার, পাউবো কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদেরা লুটেপুটে খেয়েছেন। কাজ হয়েছে শুধু লোক দেখানো।
বর্তমানে ছয়টি স্পটে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। যমুনার এমন তাণ্ডবে নদীশিকস্তি মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাপ-দাদার বসতভিটা আর সহায়সম্পদ হারিয়ে তারা এখন অসহায়। নদীর পূর্ব পাড়ে ভাঙন ক্রমেই ধেয়ে আসায় আশপাশের লোকালয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব-পশ্চিমের তীব্র বাতাসের কারণে নদীর ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে বর্ষার পানি। কয়েক দিনে পাটাগ্রাম, বাঐখোলা, ফুলজোড়, শুভগাছা, মাজনাবাড়ী, খাসরাজবাড়ী, চরগিরিশ এলাকার আশপাশের বিস্তীর্ণ জনপদ যমুনা গ্রাস করেছে। একটি মসজিদ, কয়েক শ’ বসতঘর, ফসলি জমি, গাছগাছালির বাগান বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাটা গ্রাম সডিল স্পার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ও গুচ্ছগ্রাম।
গান্দাইল ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম জানান, এবারের ভাঙনে পাটাগ্রাম গ্রামের অবশিষ্ট অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। শুভগাছা ইউপি চেয়ারম্যান এস এম হাবিবুর রহমান জানান, ভাঙনের কবলে পড়ে এ পর্যন্ত তারা তিন-চারবার বাড়ি পিছিয়েছেন। কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বকুল সরকার জানান, নদীভাঙনে তার পরিবার এ পর্যন্ত পাঁচ-ছয়বার বাড়িঘর সরিয়ে নিয়েছেন।
৩৬৮.৬৩ বর্গকিলোমিটারের জনপদ কাজিপুরের তিনভাগই যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র তিনটি। আবার যমুনার পূর্ব পাড়ে বেশ কয়েকটি চর জেগে উঠলেও চরের মালিকানা নিয়ে ভূমিহীন-জোতদারের মধ্যে চলছে বিরোধ। নদীশিকস্তি পরিবারগুলো সেখানে আশ্রয় নিতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়ছে।
এ দিকে শুভগাছা, গান্ধাইল ও কাজিপুর সদর ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দুই তিন মাসে ভাঙনে এসব এলাকার প্রায় ৩০০ বসতঘর, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, একটি মসজিদ নদীতে বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে স্পার। বেশি ভাঙছে চর এলাকা। ভাঙন এলাকার স্থান যেন বৃদ্ধি না হয় সে জন্য মনিটরিং অব্যাহত আছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ভাঙন এলাকায় ইউএনও শফিকুল ইসলাম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন।
রাজবাড়ী সংবাদদাতা জানান, রাজবাড়ীতে পদ্মার তীব্র ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন লোকজন। এক সপ্তাহের ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার বিঘা জমি। স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত নদী শাসন না করলে জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে অনেক গ্রাম ও ইউনিয়ন। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে ব্যাগে নিয়মানুযায়ী মোটা দানার বালু ভরা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
নদীপাড়ের লোকজন জানান, গত এক সপ্তাহে কয়েক হাজার বিঘা জমি হারিয়ে গেছে পদ্মায়। জেলা সদরের গোদারবাজার ঘাট, অন্তরমোড়, উড়াকান্দা, মহাদেবপুর, কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়ন, গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়ন এলাকায় চলছে নদীভাঙন। ভাঙনের তীব্রতায় নিঃস্ব হয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের ওপরে। হুমকিতে রয়েছে নদীপাড়ে অবস্থিত সরকারি বিদ্যালয়, মসজিদসহ নানা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, এমনকি শহররক্ষা বাঁধও রয়েছে হুমকিতে। জেলা সদরের চরধুঞ্চি এলাকার জলিল বলেন, ‘এ এলাকায় রয়েছে কয়েকটি মসজিদ, বিদ্যালয়সহ শত শত বাড়িঘর। নদীভাঙনে এসব এলাকার মানুষ তাদের বাড়িঘর নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, রাজবাড়ী শহররক্ষা বাঁধসংলগ্ন পদ্মার ডানতীর সংরক্ষণ বাঁধের চরধুঞ্চি এলাকায় তিন দিন ধরে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এতে প্রায় পাঁচ শ’ মিটারের বেশি সিসি ব্লক বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে ওই এলাকায় মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। চলতি মাসে শহরের গোদার বাজার ও ধুঞ্চি এলাকার শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে এ এলাকার তিনটি সরকারি প্রাথমিক স্কুল, মসজিদ এবং শত শত পরিবারের বসতবাড়ি। ফলে অনেকে তাদের ঘরবাড়ি ও সহায়সম্বল নিয়ে দূরের আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাঙনের খবর পেয়ে রোববার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী এ সময় বলেন, নদীতীরের কাছাকাছি ড্রেজিং করার ফলে গত বছরের চেয়ে এবার বেশি এলাকা ভাঙনের কবলে পড়েছে।
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জলিল মণ্ডল ও চরধুঞ্চি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দোলেনা বেগম বলেন, ঈশ্বরদীতে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি নদীপথে বহনের জন্য সরকার বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে গত এক বছর ধরে পদ্মা নদী খনন করছে। নদীর তীর ঘেঁষে এবং একই জায়গায় অনেক দিন ধরে খননকার্যক্রম চলছে। দীর্ঘদিন তাদের বাড়িসংলগ্ন নদীতে ড্রেজিং করা হচ্ছে। এভাবে টানা একই স্থানে খনন করলে তাদের বাড়িঘর ভেঙে যেতে পারে- এ কথা ড্রেজার ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এখানে যারা দায়িত্বে আছেন তারা আমাদের কথায় গুরুত্ব দেননি।
স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য কিবরিয়া বলেন, ‘ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার বাঁধের ওপরে আশ্রয় নিয়েছে।’ স্থানীয় কালাম বলেন, ‘ভাঙন অব্যাহত থাকলে বাঁধ হুমকিতে পড়বে। বাঁধ ভেঙে গেলে রাজবাড়ী শহরে পানি ঢুকবে।’
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে। তবে ব্যাগে নিয়মানুযায়ী মোটা দানার বালু ভরা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। স্থানীয় রাজু শেখ, রফিক ও মনি সরদার বলেন, ‘বস্তার মধ্যে মোটা বালু দেয়ার কথা। কিন্তু ঠিকাদাররা দিচ্ছেন চিকন বালু। চিকন বালু দেয়ায় বালুর বস্তা নদীর পানিতে ভেসে যাবে। আর যে পরিমাণ বস্তা ফেলার কথা তা ফেলা হচ্ছে না।
নি¤œমানের বালুভর্তির কথা স্বীকার করে রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান বলেন, জরুরি ভিত্তিতে এভাবে কাজ চলছে। ভাঙন রোধ হলে স্থায়ী কাজ করা হবে। কিন্তু গত তিন দিনে হাজার বস্তা নদীতে ফেলা হলেও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।
কয়েক দিন আগে শহরের গোদার বাজার এলাকায় প্রায় এক শ’ মিটার ব্লক বাঁধ বিলীন হয়ে যায়। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিওব্যাগ ও ব্লক ফেলে সাময়িকভাবে ভাঙন রোধের ব্যবস্থা নেয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার গোদার বাজার ঘাটের মাত্র পাঁচ শ’ গজ ভাটিতে চরধুঞ্চি এলাকায় আবারো ভাঙন দেখা দিলো।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এম এ খালেক জানান, ড্রেজিংয়ের কারণে নদীভাঙনে ঘরবাড়ি ভাঙার কারণে কিভাবে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় তা নিয়ে ড্রেজিং কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেছি।
মাদারীপুর সংবাদদাতা জানান, গত ২-৩ দিন ধরে পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিবচরের পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে তিনটি ইউনিয়নে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি। অনেকের বাড়িঘর নদীতে চলে গেছে। মালামাল নিয়ে তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ৩-৪ সপ্তাহের ব্যবধানে এ তিন ইউনিয়নে চারটি স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে গ্রামীণফোনের টাওয়ারসহ শত শত ঘরবাড়ি, ব্রিজ, কালভার্ট, স্কুল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
জানা যায়, ২-৩ দিন ধরে পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিবচরের পদ্মা নদীর চরাঞ্চলের চরজানাজাত, বন্দরখোলা ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক পরিবার গবাদিপশু নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ভাঙনের তীব্রতা এতই বেশি যে, অনেকেই তাদের বাড়িঘরও রেখে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। হুমকিতে রয়েছে চরজানাজাতে সোলার প্যানেল চালিত গ্রামীণফোন টাওয়ার, ব্রিজসহ শত শত ঘরবাড়ি। গত ৩-৪ সপ্তাহে চারটি বিদ্যালয় ভবন, ৫ শতাধিক ঘরবাড়িসহ চরজানাজাত ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, খাসেরহাটের অর্ধশত দোকান, চরজানাজাত ইলিয়াছ আহম্মেদ চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়, আ: মালেক তালুকদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মজিদ সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বন্দরখোলার নারিকেল বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীতে বিলীন হয়।
কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আতাহার বেপারী বলেন, গত ২-৩ দিনে পদ্মার ব্যাপক ভাঙনে কাঁঠালবাড়িসহ তিনটি ইউনিয়নে অসংখ্য বাড়িঘর স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ বলেন, গত ২-৩ দিনে শিবচরের চরাঞ্চলে পদ্মা নদীর ভাঙনের শিকার হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি। এ নিয়ে চলতি বছর ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি, চারটি স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ, হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রংপুর অফিস জানায়, পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তা অববাহিকায় হুহু করে বাড়ছে পানি। যেকোনো মুহূর্তে তা বড় বন্যায় রূপ নিতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ধরলা, ব্রহ্মপুত্রেরও একই অবস্থা। ফলে তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চরাঞ্চল ছাড়াও নদীতীরবর্তী গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। হাজার হাজার হেক্টর আমনের ধানের ক্ষেত পানির নিচে। শত শত পুকুর তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সাথে চলছে নদীভাঙন। মঙ্গলবার তিস্তার পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে এ অববাহিকা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সোমবার রাত ৯টা থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ও রাত সাড়ে ১১টায় বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকালে তা ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডালিয়া ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে।
ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম চৌধুরী নয়া দিগন্তকে জানান, গজলডোবার সব ক’টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। সোমবার রাত ৯টার পর থেকে ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র, যমুনেশ্বরী, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, ইছামতি নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নœাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। দেখা দিয়েছে ভাঙন। এ ছাড়া তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় নদীতীরবর্তী বিভিন্ন স্থানের বাঁধে আঘাত করছে। ফলে বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (রংপুর পওর সার্কেল-২) জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ নয়া দিগন্তকে জানান, পানি বৃদ্ধির কারণে তিস্তার ডান তীরের দোহলপাড়া স্পারটির সামনের অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সেটির মেরামত কাজ চলছে। পাউবোর অন্য কর্মকর্তারা বলছেন, সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিভিন্ন জেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সাথে কথা বলে এবং সরেজমিন পাওয়া তথ্য মতে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যায় নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। এ চার জেলার চরাঞ্চলের ২১০টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, তিস্তার পানি বৃদ্বি পাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়ার সাতটি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের রাস্তা, ব্রিজ ভেঙে চরসহ নিম্নœাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুর ও মাছ খামারের মাছ। পানিবন্দী পরিবারগুলো ছোট শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে বলে বিভিন্ন উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা জানান।
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের তিস্তার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল এবং পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর, ছাওলা, কান্দি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এ দিকে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ২০টি চরের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সাথে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। তিস্তার প্রবল স্র্রোতে ১৩টি পরিবারের বসতভিটা বিলীন হওয়ায় পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। তিস্তার পানি বাড়ার সাথে সাথে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা, আদিতমারী, কালিগঞ্জ ও সদর উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়েছে। কালিগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নসহ আরো দুইটি ইউনিয়নের আংশিক বন্যাকবলিত হয়েছে। পানি ঢুকছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলেও। এ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের চারটিই তিস্তা বিধৌত। তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার প্রভাব পড়েছে ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধর ও ব্রহ্মপুত্রসহ ১৬টি নদনদীতে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা পারভীন জানান, বন্যা ও ভাঙন মোকাবেলায় আমরা সব সময় প্রস্তুত থাকি। প্রয়োজনীয় খাবার ও লোকবল আমাদের মজুদ আছে। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেছেন, বন্যা ও ভাঙনঅধ্যুষিত এলাকার ডিসি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া আছে। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, বিভাগীয় কমিশনারসহ প্রশাসনের সব কর্মকর্তাকে বন্যা ও ভাঙনকবলিত মানুষের পাশে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত জুলাই মাসের বন্যায় তিস্তা ও ধরলা অববাহিকায় রাস্তাঘাট ও উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি সোমবার রাত থেকে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও মঙ্গলবার পানি কিছুটা কমে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সোমবার রাতে তিস্তা নদীর পানির চাপে ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ি এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বালির বাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে বাঁধটির ৪০০ মিটার নদীতে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া একই উপজেলার খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের দোহলপাড়া নামকস্থানে তিস্তা নদীর ডানতীরের চার নম্বর স্পার বাঁধের সামনের অ্যাপ্রোচ সড়কের ১০ মিটার নদীতে বিলীন হয়েছে। স্বেচ্ছাশ্রমের নির্মিত বালুর এ বাঁধ ভেঙে গেলে চরখড়িবাড়ি মৌজাটির দুই হাজার পরিবারের বসতভিটা তিস্তা নদীতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল আলম চৌধুরী জানান, উজানের ঢল কমে আসায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রাখা হয়েছে। এ দিকে তিস্তার উজানের ঢলের কারণে জেলার ডিমলা উপজেলার খালিশাচাপানী ইউনিয়নের ছোটখাতা, বানপাড়া ও বাঁইশপুকুর চর, ছাতুনামা ভেণ্ডাবাড়ি ফরেস্টের চর এলাকায় বেশ কিছু ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement