২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পুতিনকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে

ভ্লাদিমির পুতিন - ছবি : সংগৃহীত

শুক্রবার ভ্লাদিমির পুতিনের ৭০তম জন্মদিন। ইউক্রেনে বিপর্যয় ডেকে আনা আক্রমণের রূপকার রাশিয়ার এই প্রেসিডেন্ট কিভাবে একজন বিচ্ছিন্ন একনায়ক হয়ে উঠলেন? তার এই দীর্ঘ জীবনে সাতটি মোড় ঘোরানো ঘটনা রয়েছে। যা তার আজকের দিনের চিন্তাধারা এবং পশ্চিমা বিশ্ব থেকে তার বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে।

জুডো খেলার শুরু ১৯৬৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৮৭২ দিনের এক অবরোধের ক্ষতচিহ্ন বয়ে চলা লেলিনগ্রাদে জন্ম নেন ভ্লাদিমির পুতিন।

স্কুলজীবনেই বেশ মারকুটে স্বভাবের ছিলেন। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে স্মরণ করেন এমন একজন হিসেবে, ‘সে যেকারো সাথে মারপিটে জড়িয়ে পড়তো কারণ তার ভেতরে কোনো ভয় ছিল না।’

রাস্তায় গুণ্ডা আর গ্যাং দিয়ে ভরা শহরের হালকা পাতলা গড়নের অগোছালো সেই ছেলেটির কিছুটা ধারালো বৈশিষ্ট্যের দরকার ছিল। ১২ বছর বয়সে তিনি রাশিয়ান মার্শাল আর্ট ‘সাম্বো’ শেখা শুরু করেন এবং তারপর শেখেন জুডো।

ওই সময় থেকেই তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল স্বভাবের। ১৮ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি পেয়ে যান জুডো ব্ল্যাক বেল্ট এবং জাতীয় জুনিয়র প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি।

তার পুরুষালী ব্যক্তিত্বের যে ভাবমূর্তি, সেটি তৈরির পেছনে এই বিষয়টিকে ব্যবহার করা হয়েছে। একই সাথে এটি তার জীবনের শুরুর দিকের ওই বিশ্বাসকে জোরদার করে যে তাকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।

এটি তাকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে সাহায্য করে যে, ‘কোনো লড়াই যখন অবধারিত তখন প্রতিপক্ষকে আগে আঘাত করতে হবে। এমন শক্ত আঘাত হানতে হবে যাতে সে যেন আর কোনো দিন উঠে দাঁড়াতে না পারে।’

চাকরির খোঁজে কেজিবি ১৯৬৮
মানুষজন সাধারণভাবে লেনিনগ্রাদের চার লিটেনি প্রসপেক্টে অবস্থিত কেজিবির রাজনৈতিক পুলিশের সদর দফতর এড়িয়ে চলতো। স্ট্যালিনের যুগে এত মানুষকে-এর জিজ্ঞাসাবাদ সেল পার হয়ে গুলাগের শ্রমশিবিরে যেতে হয়েছে যে এ নিয়ে অনেকটা তিক্ত রসিকতা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

এটি ছিল এমন ‘দা বিগ হাউস’ নামে পরিচিত ‘বলশয় ডোম’ নাকি লেলিনগ্রাদের সবচেয়ে উঁচু ভবন। কারণ তার বেজমেন্ট থেকেই সোজা সাইবেরিয়া পর্যন্ত দেখা যায়। শ্রম শিবিরগুলোর বেশিরভাগই ছিল সাইবেরিয়াতে।

১৬ বছর বয়সে লালগালিচা পাতা সেই ভবনটির অভ্যর্থনা কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন পুতিন। সেখানে ডেস্কের পেছনে বসা একজন কর্মকর্তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে সেখানে কিভাবে চাকরি পাওয়া যাবে।

তাকে বলা হয়েছিল যে তার সেনাবাহিনীতে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা একটি ডিগ্রি থাকতে হবে। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কোন ডিগ্রি হলে এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হবে।

এই প্রশ্নের উত্তর ছিল আইন। সেই সময় থেকেই পুতিন আইনে স্নাতক করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। আর আইনে স্নাতক করার পর তাকে কেজিবিতে চাকরি দেয়া হয়েছিল।

রাস্তায় পোড় খাওয়া পুতিনের কাছে কেজিবি ছিল শহরের সবচেয়ে বড় গ্যাং। পার্টির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই এমন মানুষকেও তারা নিরাপত্তা দেয় এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়। কিন্তু একই সাথে প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠার সুযোগও দেয়।

ছোটবেলায় গুপ্তচরদের নিয়ে সিনেমা দেখতেন তিনি আর নিজেই বলতেন, ‘একজন গুপ্তচর হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে।’

বিক্ষুব্ধ জনতার ঘেরাও ১৯৮৯
পুতিন যত আশাই করুন না কেন, কেজিবিতে তার অবস্থানের তেমন একটা উন্নতি ঘটেনি। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী কর্মী কিন্তু শীর্ষে যাওয়ার মতো ছিলেন না।

তিনি এক পর্যায়ে জার্মান ভাষা শিখেছিলেন আর সে কারণে ১৯৮৫ সালে পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে লিয়াজোঁ অফিসে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

প্রবাসে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনই কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে বিস্ময়কর গতিতে পূর্ব জার্মানির সরকারের পতন ঘটতে শুরু করে।

ডিসেম্বরের ৫ তারিখ ড্রেসডেনে কেজিবি ভবন ঘেরাও করে বিক্ষুব্ধ জনতা। সেদিন পুতিন মরিয়া হয়ে রাশিয়ান রেড আর্মির সবচেয়ে কাছের সেনানিবাসে ফোন করে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন।

তারা অসহায়ভাবে উত্তর দিয়েছিল, ‘মস্কো থেকে আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারছি না। আর মস্কো চুপচাপ বসে আছে।’

কেন্দ্রে ক্ষমতার হঠাৎ পতনে পুতিন সেদিন ভয় পেতে শিখেছিলেন। বিরোধিতার মুখে দ্রুত জবাব না দিয়ে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচফ যে ভুল করেছিলেন, কখনোই তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে ব্যাপারে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন।

তেলের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ১৯৯২
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর পুতিন কেজিবি ত্যাগ করেন। কিন্তু দ্রুতই আজ যেটি সেন্ট পিটার্সবার্গ সেই শহরের সংস্কারপন্থী নতুন মেয়রের একজন সহায়তাকারী হিসেবে একটি কাজ জুটিয়ে ফেলেন।

দেশটির অর্থনীতিতে তখন ধস চলছিল। পুতিনের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল শহরের জনগণকে সাহায্য করার জন্য একশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল এবং ধাতব পদার্থের বিনিময়ে খাদ্যের ব্যবস্থা করা।

বাস্তবে কেউ কখনো কোনো খাবার দেখেনি। তবে একটি তদন্ত অনুযায়ী- যেটি খুব দ্রুতই চাপা দেয়া হয়। পুতিন, তার বন্ধুরা এবং শহরের গ্যাংস্টাররা টাকাটা নিজেদের পকেটে পুরেছিলেন।

উত্তাল ৯০-এর সেই দশকে পুতিন শিখে গিয়েছিলেন যে রাজনৈতিক প্রভাব এমন একটি পণ্য যা টাকায় রূপান্তর করা যায় এবং গ্যাংস্টারেরা দরকারের সময় মিত্র হতে পারে।

তার চারপাশের সবাই যখন নিজেদের অবস্থান ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছেন, তিনি কেন সেটা করবেন না?

জর্জিয়ায় হামলা ২০০৮
২০০০ সালে পুতিন যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন তখন তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে প্রভাব বলয় সৃষ্টিসহ পশ্চিমের সাথে নিজের মতো করে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন বলে আশা করেছিলেন।

কিন্তু বেশ দ্রুতই তিনি হতাশ হয়ে পড়েন, তারপর ক্ষুব্ধ। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে পশ্চিমারা ইচ্ছাকৃতভাবে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন ও অবমাননা করার চেষ্টা করছে।

জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখাইল সাকাশভিলি যখন ন্যাটোতে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তখন পুতিন ভয় পেয়ে যান। রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল দক্ষিণ ওসেটিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে জর্জিয়ার প্রচেষ্টা পুতিনের জন্য একটি শাস্তিমূলক অভিযান শুরুর একটি অজুহাত হয়ে ওঠে।

পাঁচ দিনের মধ্যে রাশিয়ার বাহিনী জর্জিয়ার সামরিক বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে এবং সাকাশভিলির ওপর একটি অপমানজনক শান্তি প্রক্রিয়া চাপিয়ে দেয়া হয়।

পশ্চিমারা তখন ক্ষুব্ধ হয়েছিল তবে এক বছরের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এমনকি মস্কোকে ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল।

পুতিনের কাছে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে শক্তিই ক্ষমতার উৎস এবং দুর্বল ও অস্থির পশ্চিমারা ফোঁসফোঁস করবে ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃঢ় সংকল্পের মুখে পিছিয়ে যাবে।

মস্কোতে বিক্ষোভ ২০১১-১৩
এটি বেশ ব্যাপকভাবে মনে করা হয় এবং যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে ২০১১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কারচুপি হয়েছিল। আর সেই বিশ্বাস দেশটিতে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভ আরো ফুঁসে ওঠে যখন পুতিন ঘোষণা দেন যে তিনি ২০১২ সালের নির্বাচনে পুনরায় দাঁড়াবেন।

এই বিক্ষোভ ‘বোলোতনায়া প্রতিবাদ’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। কারণ বিক্ষোভকারীরা মস্কোর এই নামের একটি স্কয়ারে জমায়েত হতেন। পুতিনের বিরুদ্ধে সেটি ছিল এখনো পর্যন্ত জনসাধারণের সবচেয়ে ব্যাপকভিত্তিক বিরোধিতা।

পুতিনের বিশ্বাস ছিল যে এই সমাবেশগুলো ওয়াশিংটনের প্ররোচনায় শুরু, উৎসাহিত ও পরিচালিত হয়েছিল। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে এসবের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ করেছিলেন।

পুতিনের কাছে এটি ছিল প্রমাণস্বরূপ যে পশ্চিমারা সরাসরি তার দিকেই আসছে এবং যে কারণে কার্যত তিনি এখন যুদ্ধে লিপ্ত।

কোভিডের কারণে বিচ্ছিন্নতা ২০২০-২১
কোভিড-১৯ যখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তখন পুতিন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চলে যান, খুব ব্যক্তিত্ববাদী স্বৈরাচারীদের জন্যও যা ছিল অস্বাভাবিক।

তার সাথে যারাই দেখা করতে যাচ্ছিলেন তাদের প্রথমে পুরো ১৪ দিনের জন্য কঠোর পাহারায় বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো। তারপর তাদেরকে জীবাণুনাশক ‘আল্ট্রাভায়োলেট লাইট’ ও স্প্রে পার হয়ে তার কাছে যেতে হতো।

এই সময় জুড়ে পুতিনের সাথে মুখোমুখি দেখা করতে সক্ষম এমন মিত্র ও উপদেষ্টাদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। খুব মুষ্টিমেয় কয়েকজনে সীমাবদ্ধ হয়েছিল তাদের সংখ্যা। যারা কেবল ‘জ্বি আজ্ঞে’ বলা লোক এবং তাদের সহযোগী।

বিকল্প মতামত তার কাছে তখন খুব কমই পৌঁছাত। সে সময় পুতিন সম্ভবত শিখেছেন যে তার সমস্ত অনুমান ও বিশ্বাস সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত ছিল এবং তখনই সম্ভবত ইউক্রেন আক্রমণের বীজ বপন করা হয়েছিল।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement