২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাবমেরিন ইস্যু : ‘ক্রুদ্ধ’ ম্যাক্রঁ কি বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেললেন?

- ছবি- সংগৃহীত

চীনকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন মিলে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করে দেয়ার জন্য অকাস নামের যে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে- তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছে ফ্রান্স। অনেকে বলবেন, এ চুক্তি যত না নাটকীয় ছিল তার চেয়েও বেশি নাটকীয় ছিল ফ্রান্সের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া, যা সবার নজর কেড়েছে। ক্ষিপ্ত ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক দু’টি প্রশ্ন তুলেছেন।
১. ফ্রান্স কি বাড়াবাড়ি রকমের নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছে? ২. এর বেশি ফ্রান্স আর কী করতে পারে?

আমেরিকান বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এমানুয়েল ম্যাক্রঁ ঝুঁকি নিতে ভয় পান না ঠিকই। কিন্তু এবার তিনি খুব বেশি বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন।

'ম্যাক্রঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য'
তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ ইভ লু দ্রিয়াঁকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পিঠে ছুরি মারা, মিথ্যা, দ্বিচারিতা, অপমান, নির্মমতা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে দিয়েছেন, যা সচরাচর কূটনীতিতে শোনা যায় না। আর যখন ব্যাপারটা দুই মিত্র দেশের মধ্যে, তখন তো একেবারেই নয়।

অনেকে বলছেন, এই যে দ্বিধাহীন স্পষ্টবাদিতা, এটা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এ জন্যই তিনি মাত্র ৩৯ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এর আগে তিনি তুরস্ক ও ইতালি থেকেও ফরাসী রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করেছিলেন।

নজিরবিহীন
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত দেশে ফিরিয়ে আনার ঘটনা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর আর ঘটেনি। বিবিসির বিশ্লেষক বারবারা প্লেট-আশার লিখেছেন, এটা এক নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি বলেন, আমেরিকার প্রাচীনতম বন্ধু ফ্রান্স। হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারাও একথা উল্লেখ করেছেন। আসলেই তাই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল ব্রিটেনের বিরুদ্ধে। ওইসময় তার মিত্র ছিল ফ্রান্স।

ফ্রান্স 'গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত, অপমানিত'
ফ্রান্সের এত ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ প্রধানত তিনটি। ১. অকাস চুক্তি করার আগে অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের সাথে করা ডিজেলচালিত ১২টি সাবমেরিন নির্মাণের চুক্তিটি বাতিল করে, যা ছিল চার হাজার কোটি ডলারের এক বিশাল চুক্তি। এটি বাতিল হওয়ায় ফ্রান্সের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। তা ছাড়া ফ্রান্সের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের কিছু না জানিয়ে অত্যন্ত গোপনে করা এই চুক্তি করে ফ্রান্সকে অপমান করা হয়েছে। ন্যাটো মিত্রদের মধ্যকার বিশ্বাস ও আস্থা এতে ভেঙে গেছে।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ফ্রান্সের নিজস্ব স্বার্থ আছে। সেখানে নিউ ক্যালেডোনিয়ার মতো দ্বীপগুলোতে বহু ফরাসি নাগরিক বাস করেন। সেখানে কয়েক হাজার ফরাসি সৈন্যও মোতায়েন আছে। তাই অস্ট্রেলিয়ার সাথে সাবমেরিন চুক্তি বাতিল হওয়ায় ফ্রান্স ওই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির একটি সুযোগ হারালো।

কিন্ত ম্যাক্রঁর হাতে খেলার মতো তাস আছে কি?
ন্যাটো জোটের যে সমন্বিত সামরিক কমান্ড কাঠামো, ২০০৯ সাল থেকে ফ্রান্স তার সদস্য হলেও এর আগের ৪৩ বছর ফ্রান্স এতে ছিল না। অকাস সাবমেরিন চুক্তি নিয়ে এই বিপত্তি বাঁধার পর ইউরোপের কিছু মহলে এই কথাটা ঘুরছে যে ফ্রান্স এই কমান্ড কাঠামো থেকে আবার বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এরকম সম্ভাবনা নেই।

ফ্রান্স ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ও ন্যাটো জোটের সদস্য। কিন্তু বছর দুয়েক আগেই ম্যাক্রঁ ন্যাটোকে 'ব্রেইন-ডেড' বা 'কার্যত মৃত' বলে বর্ণনা করেছিলেন। ম্যাক্রঁ মনে করেন, এই সাবমেরিন-কাণ্ডে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ন্যাটো জোট এখন পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবে পঙ্গু ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে জিনিসটা আঠার মতো সবাইকে একসাথে রেখেছিল, তা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ফরাসিরা মনে করছে, সাবমেরিন চুক্তি যেভাবে করা হয়েছে তাতে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। এটা না থাকলে জোট কথাটার কোনো অর্থ নেই,’ বলছেন নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষক রজার কোহেন।

এমানুয়েল ম্যাক্রঁ বেশ কিছুকাল ধরেই ন্যাটোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ইইউর একটি নিজস্ব সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলছিলেন। এখন কি তাহলে তিনি সেই প্রয়াস আরো জোরদার করতে ইইউকে চাপ দেবেন?

ইইউ এখনো ফ্রান্সের চেয়ে ন্যটোকে বেশি গুরুত্ব দেয়
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবতা হলো- ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিজেদের নিরাপত্তা ও রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলার জন্য ন্যাটোর জোটের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলো আগে সোভিয়েত প্রভাবাধীন ছিল, এখন ইইউর সদস্য হয়েছে- তারাও ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। কয়েকটি দেশ সদস্য হওয়ার চেষ্টায় আছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এখন নিউইয়র্কে আছেন জাতিসঙ্ঘের সভায় যোগ দিচ্ছেন। সেখানেই এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর তারা ফ্রান্সকে সমর্থন দিয়েছেন। ইইউর পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, অস্ট্রেলিয়া যে ফ্রান্সের সাথে করা সাবমেরিন চুক্তি বাতিল করে মার্কিন ও ব্রিটিশ প্রযুক্তিতে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির চুক্তি করেছে, তাতে তারা বিস্মিত।

ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লাইনও বলেছেন, ফ্রান্সের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু মার্কিন বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এখন বিভক্ত। সার্বিকভাবে বলতে গেলে, ফ্রান্স তাদের এই অপমানের পর ইইউ থেকে খুব বেশি সাড়া পায়নি।

রজার কোহেনের মতে, জার্মানি ছাড়াও পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোর কাছে ন্যাটোর মাধ্যমে পাওয়া আমেরিকান সুরক্ষার গুরুত্ব ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ফ্রান্সের স্বার্থের চাইতে অনেক বেশি।

ইউরোপকে নিজের পথ তৈরি করে নেয়ার কথা বলছিলেন ম্যাক্রঁ
ন্যাটো জোট গঠিত হয়েছিল মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে মাথায় রেখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন বিলুপ্ত। এখন সামরিক বা কৌশলগত জোটগুলোর মূল নজর এশিয়ার দিকে। অনেকের মতে সেখানে প্রধান প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে চীন। এ কারণেই ম্যাক্রঁ অনেক দিন ধরেই ইউরোপের স্বতন্ত্র পথে চলার কথা বলছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সাবমেরিন-কাণ্ড, আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার, ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ, চীনকে মোকাবিলার প্রশ্নে আটলান্টিকের দুই তীরের মতপার্থক্য- এসব ঘটে যাওয়ার পর ম্যাক্রঁর কথাবার্তা আরো বেশি যৌক্তিক শোনাচ্ছে।

বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের চার্ট
সাবমেরিন চুক্তিটিতে একদিকে যেমন ম্যাক্রঁর আবেদনের সারবত্তা জোরদার হয়েছে। ঠিক তেমনি এটাও আরো স্পষ্ট হয়েছে যে ম্যাক্রঁ আসলে একা। তিনি ঠিক কথাই বলছেন। কিন্তু তার সাথে কেউ নেই। এমনটাই বলছেন আরেকজন মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডমিনিক মোইসি। মোইসি আরো বলছেন, ঐতিহাসিকরা হয়তো একে একটা মোড়বদলকারী ঘটনা হিসেবে দেখতে পারেন। হয়তো এতে বোঝা যাচ্ছে যে ন্যাটোর দিন শেষ হয়ে আসছে বা একটি অধিকতর বিপজ্জনক পৃধিথবীতে ন্যাটো গৌণ হয়ে পড়ছে।

এরপর কী করতে পারেন ম্যাক্রঁ
বিশ্লেষকরা বলছেন, ম্যাক্রঁর হাতে কিছু তাস এখনো আছে। কোহেন বলছেন, চীনে জার্মানির বিশাল অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে। বাইডেন চীনের প্রতি যে নীতি নিয়েছেন- তাতে তারাও উদ্বিগ্ন। জার্মানির সাথে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যকার বাণিজ্যের চেয়েও বেশি। তাই ফ্রান্স ও জার্মানি মিলে চীনের প্রতি মিত্রতাপূর্ণ অবস্থান নিতে পারে।

তার মতে, ম্যাক্রঁ ও বাইডেনের মধ্যে কথাবার্তা হলে তিক্ততা কমে যেতে পারে। তবে অতীতেও ফ্রান্স ও আমেরিকার মধ্যে বিবাদ হয়েছে, এমন ইতিহাস আছে। তা ছাড়া ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ, ২০১৩ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকার সময় সিরিয়ায় বোমাবর্ষণ না করার আকস্মিক সিদ্ধান্ত- দু’পক্ষের সম্পর্কে সঙ্কট তৈরি করেছিল।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের স্মৃতিশক্তি প্রখর ও ইরাক যুদ্ধে ফ্রান্সের বিরোধিতায় তিনি খুবই নাখোশ হয়েছিলেন। ম্যাক্রঁ এখন ক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে যাওয়া ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ফিলিপ এতিয়েঁ ফরাসি দৈনিক লা মঁদকে বলেছেন, প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি এখনো প্রবল। তিনি ফ্রান্সে নির্বাচনের ছয় মাস আগে নিজেকে নরমপন্থী হিসেবে দেখাতে চান না। তাহলে তার দক্ষিণপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী মারিন লা পেন এ সুযোগ নিতে দ্বিধা করবেন না।

তাই ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। এমানুয়েল ম্যাক্রঁর মন থেকে ন্যাটোর ব্যাপারে সন্দেহ সহজে যাবে না। তবে তার হাতে আর কোনো বিকল্প আছে কিনা- সেটা অবশ্য অন্য প্রশ্ন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement