২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পর্তুগাল স্বৈরচারমুক্ত হয়েছিল যেভাবে

আজ পর্তুগাল স্বৈরচারমুক্ত দিবস - ছবি- সংগৃহীত

আজ ২৫ এপ্রিল। পর্তুগালবাসীর জন্য একটি আনন্দের দিন। কারণ এ দিনেই পর্তুগালবাসী স্বৈরাচারের শোষণমুক্ত হয়েছে। ঐতিহাসিক এ ঘটনাটি ১৯৭৪ সালের।

জানা গেছে, ৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল চার দশকের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকের দখল থেকে মুক্ত হয় পর্তুগাল। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত আর্মড ফর্সেস মুভমেন্টের (এমএফএ) চৌকস অফিসারদের কয়েক মাসের চেষ্টার ফলে রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র ফ্যাসিবাদ সরকার মার্সেলো কেতানোর পতন হয় এ দিন। সামরিক বাহিনীর এই সাফল্যে জনগণ যখন রাস্তায় নেমে আসে। তখন এক নারী খুশি হয়ে কার্নেশান ফুল সৈনিকের রাইফেলের আগায় গেঁথে দেন। তাই পর্তুগালের ইতিহাসে এই দিনটিকে কার্নেশান বিপ্লব বলেও স্মরণ করা হয়।

পর্তুগালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৩২ সালে অ্যান্তোনিও সালেজার যখন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হন তখন তিনি সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দেন। সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে তখন নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের আদেশ দেয়া হয়। এই সংবিধান এস্তাদো নোভো (নতুন স্টেট) প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৩৩ সালে তিনি সংবিধানের নতুন স্টেটের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর থেকে সালেজার গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে এমন একটি শাসন ব্যবস্থা জারি করেন যা মূলত দমন পীড়নের ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল।

পর্তুগিজরা কখনোই ভাবেনি যে এই অ্যান্তোনিও সালেজার দমন পীড়ন করে, সামরিক বাহিনী দিয়ে ৩৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকতে পারবে। কিন্তু সালেজার ক্ষমতাকে চ্যালঞ্জ করার মতো কোনো বিরোধী দল তখন ছিল না। স্বৈরশাসন শুরুর পর প্রথম দিকে সালেজার বিরুদ্ধে কিছুটা আন্দোলন হলেও সালেজা তা বেশ দক্ষতার সাথে সামলে নেন। স্ট্রোক করে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকেন ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। তারপর তিনি ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্সেলো কাতেনোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই মার্সোলো কাতেনো উনার পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করে ৭৪ সালের অভ্যুত্থান পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।

সামরিক অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ৭৮ বছর বয়সি ভাস্কো লরেন্স এই দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, আমরা অভ্যুত্থানের ঠিক মাস দেড়েক আগে পাঁচ মার্চ লিজবনের অদূরে কাসকাইস শহরে মিলিত হই। আমাদের এই সভায় প্রথম সিদ্ধান্ত হয় যে আমরা এই ফ্যাসিবাদ সরকার পতনের জন্য পদক্ষেপ নেবো। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হয়, আমাদের এই সামরিক অভ্যুত্থান যেন রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য হয় তা নিশ্চিত করা। তাই তৎক্ষণাত আমরা এই প্রকল্পের পরিকল্পনা জাতির সামনে পেশ করার জন্য একটি কমিশন গঠন করি, যাতে জনগণ আমাদেরকে ভুল না বুঝে। তৃতীয় সিদ্ধান্ত ছিল, অভ্যুত্থানের পর নেতৃত্ব দেয়ার মতো দক্ষ লোকের প্রয়োজন। আমরা সর্বসম্মতভাবে জেনারেল কোস্টা গোমস ও জেনারেল স্প্যানোলাকে নেতৃত্বের জন্য বেছে নেই।

পর্তুগালের আফ্রিকান উপনিবেশগুলো যেমন অ্যাঙ্গোলা, গিনি বিসাউ ও মোজাম্বিকজুড়ে অভ্যুত্থানের বেশিরভাগ পরিকল্পনা ওখানেই হয়েছিল। সেখানকার সরকারও কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ভাস্কো লরেন্স বলেন, অভ্যুত্থানের কয়েক সপ্তাহ আগে আমাকে ও কয়েকজন সামরিক অফিসারকে লিজবন থেকে দ্বীপাঞ্চল আজোরসে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাকে ক্যাপ্টেনের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সত্যি কথা বলতে কি, ওই সময়টাকে এতো বেশি মরিয়া ছিলাম যে ধ্যানে জ্ঞানে চিন্তায় শুধু একটাই, আমাদেরকে পারতেই হবে। বিজয়ী হতেই হবে। জনগণকে মুক্তি দিতেই হবে। যখন কাঙ্ক্ষিত দিন এলো, আমি তখন রেডিওতে গান শুনতে শুনতে পায়চারি করেছিলাম। হঠাৎ করে গান বন্ধ হলে কৌতূহল নিয়ে রেডিওর কাছে যাই ও শুনতে পাই সামরিক অফিসারদের ভাষণ, বিজয়ী কণ্ঠ। মুহূর্তেই আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে লাফাতে থাকি।

অপারেশন পরিকল্পনাটি সমন্বিত করেছিলেন মেজর ওতেলো সরাইভা ডি কারভালহো। সিগন্যালটি দেয়া হয়েছিল ২৪ এপ্রিল রাতে। রেডিওতে ই ডিপোস দো অ্যাডিয়াস গানের সম্প্রচারের মাধ্যমে। তারপরে জোসে আফোঁসোর রচিত গ্রানডোলা, ভিলা মোরেনা, যখন মধ্যরাতের রেডিওতে শোনা গেলো, তখন সবাই নিশ্চিত হলো যে কার্নেশন বিপ্লবের সূচনা হচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনী ব্যারাক থেকে বের হয়ে এসে তাদের লিসবনের সমস্ত রাস্তায় ছড়িয়ে যায়। তারা শহরের সমস্ত কৌশলগত ক্ষেত্র দখল করে। রেডিও, টেলিভিশন, সামরিক সদর দফতর ও বিমানবন্দর ইত্যাদি। সশস্ত্র বাহিনী সারাদেশে বিভিন্ন শহর যেমন সান্তারাম, মাফরা, তোমার ও ভিসেউতে একসাথে অভিযান চালায়।

এর ঠিক ছয় ঘণ্টা পর স্বৈরশাসক মার্সেলো কেতানোর জেনারেল স্প্যানোলা কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। এর পরক্ষণেই জনগণ উচ্ছ্বসিত হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এর ঠিক একবছর পর ১৯৭৫ সালের ২৫ এপ্রিল পর্তুগালে ভোটের আয়োজন করা হয়। এরপর দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার। তাই এই দিনটিকে অনেকে পর্তুগালের গণতন্ত্র দিবসও বলে থাকেন।

পর্তুগালের নতুন সরকার উপনিবেশিক যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭৪-এর শেষ নাগাদ পর্তুগিজ গিনি থেকে পর্তুগিজ সেনা প্রত্যাহার করা শুরু করা হয়। পরবর্তীকালে তারা জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পায়। এরপর ১৯৭৫ সালে কাপো ভার্দে, মোজাম্বিক, সাও টোমে, প্রিন্সিপ ও অ্যাঙ্গোলাকে স্বাধীনতা দেয় পর্তুগাল।


আরো সংবাদ



premium cement