২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ইসলামের বিরুদ্ধে এখন কেন উঠে পড়ে লেগেছেন ম্যাক্রঁ

ইসলামের বিরুদ্ধে এখন কেন উঠে পড়ে লেগেছেন ম্যাক্রঁ - ছবি : এএফপি

ফ্রান্স যে অস্বাভাবিক একটি সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তার অন্যতম একটি প্রতীক রাজধানী প্যারিসের উত্তর-পূর্বে মুসলিম অধ্যুষিত পাতা এলাকার একটি মসজিদ। ছোটে ছোট জানালাওয়ালা ইস্পাতের ঢেউটিনের তৈরি গুদামের মত দেখতে এই মসজিদে এখন তালা।

বাইরে একটি নোটিশ টাঙ্গানো হয়েছে যাতে লেখা আছে ‘কট্টর ইসলামি তৎপরতায় লিপ্ত থাকা ও শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে টার্গেট করে সোশাল মিডিয়ায় ভিডিও পোস্ট করার কারণে’ সরকার এই মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে।

ইতিহাসের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যা ও শিরশ্ছেদ করার প্রতিক্রিয়ায় কট্টর ইসলামের বিরুদ্ধে ফরাসী সরকার ‘দ্রুত ও কঠোর’ সব পদক্ষেপ নিচ্ছে। মসজিদ-সংগঠন বন্ধ, বাড়িতে তল্লাশি চলছে, গাদা গাদা নতুন তদন্ত এমন আরো নতুন নতুন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের কথা প্রতিদিন যেভাবে শোনা যাচ্ছে যে তা মনে রাখাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

‘ভীতি এখন অন্য পক্ষের ওপর চাপবে’ - দু’দিন আগে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর উচ্চারিত এই বাক্যটি এখন মুখে মুখে ঘুরছে।

সরকারের দেয়া হিসাবে ১২০টি বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। কট্টর ইসলামি মতবাদ প্রচারের অভিযোগে বেশ কিছু সংগঠন ও সমিতি বাতিল করা হয়েছে। সন্ত্রাসে অর্থ জোগানোর রাস্তা বন্ধের কৌশল নেয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য বাড়তি সাহায্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেই সাথে, পোস্ট-ভিডিও-ছবির ওপর নজরদারি বাড়াতে সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর শাসনামলে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলায় ফ্রান্সে পুলিশের সদস্যসহ কমপক্ষে ২০ জন মারা গেছে। কিন্তু তার সরকারের কাছ থেকে এমন তৎপরতা আগে চোখে পড়েনি।

এখন কেন এত শক্ত পথ নিচ্ছেন তিনি?
ফরাসী জনমত জরিপ সংস্থা আইএফওপি‘র পরিচালক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেরোম ফোরকোয়া বলেন, এবারের হত্যাকাণ্ডটি ছিল ভিন্নতর, একজন শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে ও অত্যন্ত ‘পাশবিক‘ কায়দায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার মতে, এ কারণেই সরকার এবার অত্যন্ত কঠোর হয়েছে।

‘আমরা এখন আর শুধু সংগঠিত জিহাদি নেটওয়ার্কের মোকাবেলা করছি না,’ ফোরকোয়া বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক সন্ত্রাসীকে দেখলাম যার কট্টরপন্থায় দীক্ষা এদেশে বসেই হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার এখন মনে করছে যে শুধু আইন-শৃঙ্খলার বেড়ি দিয়ে এই সন্ত্রাসের মোকাবেলা সম্ভব নয়। তাদেরকে এখন সামাজিক নেটওয়ার্ক সামলাতে হবে, কারণ ট্র্যাজিক এই হত্যাকাণ্ড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে কিভাবে এসব নেটওয়ার্ক জনগণের মধ্যে ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুরো এই ব্যবস্থাটি বদলাতে হবে।’

ফোরকোয়া বলেন, দুই বছর আগে তাদের প্রতিষ্ঠানের এক জনমত জরিপে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষক বলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার ইস্যুতে সংঘাত এড়াতে তারা ক্লাসরুমে ‘সেলফ- সেন্সরশিপের’ পথ বেছে নিয়েছেন। এই বিশ্লেষক মনে করেন, ফ্রান্সের আইনের বিরুদ্ধে এই যে ‘আদর্শিক হুমকি’ তা মোকাবেলায় এই সরকার যে পথ নিচ্ছে তা সঠিক।

কিন্তু ম্যাক্রঁ সরকারের এই কৌশল নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে ফ্রান্সে।

ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার পর সায়েন্টিফিক রিসার্চের সমাজবিজ্ঞানী ল্যঁরা মুচ্চেলি মনে করেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ‘মাত্রাতিরিক্ত‘ তৎপরতা দেখাচ্ছেন এবং তার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ। তার মতে, ম্যাক্রঁর মাথায় এখন বিশেষ করে ২০২২ সালের নির্বাচনের কথা ঘুরছে।

`ম্যাক্রঁ আগুনে ঘি ঢালছেন,' বলেন মুচ্চেলি। `তিনি চাইছেন জনগণ যেন মনে না করে যে তিনি ডানপন্থী বা কট্টর ডানপন্থীদের চেয়ে এক পা হলেও পিছিয়ে। তার প্রধান লক্ষ্য ২০২২ সালের নির্বাচন জেতা। উনবিংশ শতাব্দী থেকেই তাদের (কট্টর ডানপন্থীদের) প্রধান টার্গেট অভিবাসন এবং নিরাপত্তা।'

গত সপ্তাহে একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই ইস্যুতে অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ও অভিবাসী-বিদ্বেষী রাজনীতিক মারি ল পেনের ওপর ভরসা করেন। ১৮ মাস পর যে নির্বাচন হচ্ছে সেখানে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন মারি ল পেন।

প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বিদেশে ভাবমূর্তি গড়তে ও দেশে অর্থনৈতিক সংস্কারে প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হলেও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ইস্যুতে জনগণের মধ্যে যথেষ্ট আস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছেন। পক্ষান্তরে, তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মারি লা পেন যেভাবে ইসলামকে ফ্রান্সের জাতীয় সত্ত্বার জন্য হুমকি হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচুর মানুষ তা বিশ্বাস করছে।

সাংস্কৃতিক সংঘাত
ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই ম্যাক্রঁ নিরাপত্তা হুমকি ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতর একটি বিভেদ- রেখা বজায় রাখার সচেতন চেষ্টা করে গেছেন। অনেকদিন ধরে তিনি হিজাব, বুরকিনি বা স্কুলে হালাল খাবার দেয়ার মত বিতর্কিত ইস্যুতে মতামত দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন।

তবে ধর্মের সাথে ফ্রান্সের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংঘাত এতটাই তীব্র যে এ নিয়ে চুপ থাকা প্রায় অসম্ভব।

সেপ্টেম্বর মাসে একটি পার্লামেন্টারি কমিটিতে এক শুনানির সময় হিজাব পরা একজন মুসলিম নারী কথা বলা শুরু করার সাথে সাথে ম্যাক্রঁর দল অ্যঁ মাকশের এমপি অ্যান-ক্রিস্টিন ল্যাং কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। পরে ওই এমপি বলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রের হৃদস্পন্দন যেখানে সেই পার্লামেন্টের ভেতর হিজাব পরিহিত কাউকে আমি মেনে নিতে রাজী নই।’

ফ্রান্সে সরকারি চাকরিজীবী যেমন শিক্ষক বা নির্বাচিত মেয়র কর্মস্থলে এমন কিছু পরতে বা ব্যবহার করতে পারেন না যাতে তার ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকাশিত হয়। তবে সাধারণ মানুষের ওপর তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই।

তারপরও একজন অভিভাবক হিজাব মাথায় দিয়ে তার বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা অথবা বুরকিনি অর্থাৎ আপাদমস্তক সাঁতারের পোশাক পরা কাউকে বিচে যেতে দেয়া উচিৎ কিনা তা নিয়ে ফ্রান্সে বিতর্ক কখনই থামেনি।

কট্টর ডানপন্থীরা সবসময় বলে বেড়ান যে মুসলিমদের তোষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বামপন্থীরা এসব বিতর্ক তোলাকে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ বলে আখ্যা দেন। এসব বিতর্কের মাঝেই এ মাসে ক্লাসে মত প্রকাশের স্বাধীনতা পড়াতে গিয়ে নবীর কার্টুন দেখানোর ইস্যুতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে।

আন্তর্জাতিক মাত্রা
শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ যেভাবে দেখাচ্ছেন দেশের ভেতর তার জনপ্রিয়তা বাড়ুক বা কমুক বাইরের দুনিয়ায়, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে, তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

লিবিয়া, বাংলাদেশ, গাজা এবং তুরস্কে বিক্ষোভ হয়েছে। তুরস্কের সাথে বাক-যুদ্ধ বেড়েছে। তুরস্কসহ কিছু মুসলিম দেশে ফরাসী পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে।

ফরাসী প্রেসিডেন্ট গত সপ্তাহে ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ধরে রাখার ব্যাপারে ‘ফ্রান্স কখনই কার্টুন আঁকা বন্ধ করে দেয়নি‘ বলে যে মন্তব্য করেন তা নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ম্যাক্রঁর মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রতিবাদে ফ্রান্স তুরস্ক থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে এসেছে।

তবে ফ্রান্স এবং তুরস্কের মধ্যে বৈরিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে লিবিয়ায় অস্ত্র সরবরাহ, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান ও সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে তুরস্কের সামরিক অভিযান এসব নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বাদানুবাদ চরমে উঠেছে।

এখন একজন শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডের পর ম্যাক্রঁ যেভাবে সাড়া দিচ্ছেন তাতে এই দুই দেশের বিরোধে নতুন এক মাত্রা যোগ হয়েছে। রাজনীতি ও বিদেশনীতির পাশাপাশি এখন যোগ হয়েছে ধর্ম।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক

সকল