২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনার দিনে স্লোভেনিয়াতে অন্য রকম এক ঈদ-উল-আজহা!

আইডোসচিনাতে আয়জিত এবারের ঈদ-উল-আজহার নামাজের জামায়াত - -লেখক

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আজ স্লোভেনিয়াতেও উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা।

প্রায় একুশ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট স্লোভেনিয়াতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানিটি। এরপরই দেশটির সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে। গত ২০১৮ সালের এক জরিপ অনুযায়ী স্লোভেনিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩.৭ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে। স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই বসনিয়ান এবং আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত। ১৯৯২ সালে সংগঠিত যুগোস্লাভ যুদ্ধের সময় সার্বদের গণহত্যা ও বিভিষীকা থেকে বাঁচার জন্য বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ও কসোভো থেকে নিরাপদ জীবনের আশায় অনেক মানুষই স্লোভেনিয়াতে পাড়ি জমান যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম। এরাই আজকের দিনের স্লোভেনিয়ার জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে ঈদ উপলক্ষে কোনও সরকারি ছুটি থাকে না। তাই এখানকার মুসলিম অধিবাসীদের মাঝে ঈদ আবির্ভুত হয় বছরের অন্যান্য সাধারণ এক কর্মব্যস্ত দিনের মতো।

গত পনেরো মে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে স্লোভেনিয়া করোনা মহামারি পরিস্থিতির অবসানের ঘোষণা দেয়। তবে গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ দেশটিতে নতুন করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। স্লোভেনিয়ার গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে লকডাউন শিথিল ও প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সীমান্ত সংযোগ পুনরায় চালু করার পর বলকান দেশ বিশেষ করে সার্বিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া, কসোভা এ সকল দেশ থেকে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধির কারণে দেশটিতে নতুন করে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে।

উল্লেখ্য যে গোটা ইউরোপে রাশিয়ার পর পর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলকান এ সকল দেশ। তাই নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ভয়ে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর উদ্বোধন হওয়া দেশটির ইতিহাসের প্রথম অফিসিয়াল মসজিদে এ বছর কোনও ঈদ জামায়াতের অনুমতি দেয়া হয়নি। এমনকি দেশটির রাজধানী লুবলিয়ানাসহ অন্যান্য বৃহত্তর নগরী যেমন- মারিবোর, ক্রানিয়ে, ছেলইয়ে এ সকল স্থানেও সেভাবে ঈদ জামায়াতের খবর পাওয়া যায়নি।

তবে স্লোভেনিয়াতে আমার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস যে স্থানে অর্থাৎ আইডোসচিনাতে অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে জামায়াতবদ্ধভাবে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়। আইডোসচিনা এবং এর আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা একটি ফ্ল্যাট কিনে সেখানে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কিন্তু এটি কোনো অফিসিয়াল মসজিদ নয়। যেহেতু স্লোভেনিয়ার সরকার করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে একই সাথে পঞ্চাশজনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে তাই কয়েক গ্রুপে বিভক্ত করে এ ঈদ জামায়াতের আয়োজন করা হয়। সকাল ছয়টা থেকে আরম্ভ করে সকাল দশটা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চারটি ঈদ জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। কোনো নির্দিষ্ট গ্রুপে এক সাথে ত্রিশ জনের বেশি মানুষকে একত্রিত হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি এবং যারা যারা নামাজে অংশ নিতে আগ্রহী ছিলো সবাইকে ঈদের একদিন আগে অর্থাৎ গতকাল ইমামের সাথে যোগাযোগ করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হয়েছিলো। ইমাম নির্ধারিত করে দেয় কে কোন গ্রুপে কোন সময় নামাজের জন্য উপস্থিত হবে। ইমাম সাহেবের অনুমতি ছাড়া কাউকে ঈদের নামাজে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়নি, তাছাড়া মসজিদে প্রবেশের আগে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মুখে মাস্ক পরিধান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হয়েছিলো। পাশাপাশি দুইজন মুসল্লীর মাঝে ফাঁক রাখা হয়েছিলো এবং প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট টোকেন নম্বর দেয়া হয়েছিলো। কে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে সেটা এ টোকেন নাম্বারের ভিত্তিতে নির্ধারিত করা হয়েছিলো।

এছাড়াও করোনা সংক্রমণ এবং একই সাথে যেহেতু শুক্রবার স্লোভেনিয়াতে কর্মদিবস তাই সে চিন্তা মাথায় রেখে নামাজ ও খুতবার সময় যতোটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করে আনা হয়েছিলো।

বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া, কসোভো এ সকল দেশে ইসলাম ধর্মের বিস্তারের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকেরা। তাই এ সকল দেশের মুসলমানেরা আরবি কিংবা ফারসির তুলনায় তুর্কি ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দেয় ধর্মীয় বিষয়গুলোকে ইঙ্গিত করার জন্য। যেমন- আমাদের দেশে আমরা একে-অপরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ‘ঈদ মোবারক’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করি কিন্তু তারা ঈদ মোবারকের পরিবর্তে ‘বায়রাম ওলসুন’ শব্দটি ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তুর্কি ভাষায় ঈদকে বায়রাম বলা হয়। এমনকি তাদের দেশের মসজিদগুলো তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের স্থাপত্যশৈলীকে অনুসরণ করে নির্মিত। যেহেতু ঈদ জামায়াতে আসা মুসল্লিদের বেশির ভাগই বসনিয়ান বংশোদ্ভূত, তাই ইমাম সাহেবও খুতবা দিয়েছিলেন বসনিয়ার স্থানীয় ভাষায়। আমাদের দেশেও যদি আরবি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় খুতবা দেয়া হয় তাহলে মানুষের কাছে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অধিক ফলপ্রসূভাবে পৌঁছাবে।

ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের ন্যায় পশুর হাটের রীতি নেই। পাশাপাশি আমাদের দেশের মতো সেখানে জনসম্মুখে পশু জবাই করা নিষিদ্ধ। যারা সামর্থ্যবান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা নিকটস্থ কোনও মসজিদের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অথবা কোনও গোশতের দোকানের সাথে যোগাযোগ করে কুরবানির ব্যবস্থা করেন। তারাই কুরবানির যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এক থেকে দুই দিনের মাথায় বাসায় গোশত পৌঁছে দেয়।

স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বলতে গেলে একেবারে হাতেগোনা। সব মিলিয়ে মধ্য ইউরোপের এ দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরদের সংখ্যা হবে ৩০ থেকে ৪০ জনের মধ্যে। ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ফ্রান্স, ইতালি, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগাল এ সকল দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে এখনও সেভাবে বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে উঠেনি। এ কারণে নিজেদের মাঝে সেভাবে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশিদের মাঝে ঈদ আয়োজন বলতে গেলে অনেকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বড় শহর যেমন- লুবলিয়ানা কিংবা মারিবোরে অনেক সময় দেখা যায় কতিপয় বাংলাদেশি একত্রিত হয়ে ঈদ উপলক্ষে নিজেদের মাঝে ছোটোখাটো একটি আয়োজনের ব্যবস্থা করে। স্লোভেনিয়ার প্রতিবেশি রাষ্ট্র অস্ট্রিয়া এবং ইতালিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের বসবাস রয়েছে এবং এ দেশ দুইটিতে বাংলাদেশিদের শক্তিশালী কমিউনিটি রয়েছে। আমাদের দেশের মতো সেখানেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঈদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশেষ করে সেকেন্ড ওয়েভে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ মুহূর্তে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রাখা হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে ইচ্ছা থাকলেও সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশগুলোতে দেশে যাতায়াত করা সম্ভব হয় না। অনেকটা একাকীত্বের মাঝে চলে যায় এখানকার বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঈদ আনন্দ।

কোনো জিনিস না হারালে মানুষ আসলে বুঝতে পারে না তার মর্ম আদৌতে কতোটুকু? বাংলাদেশ ছেড়ে যখন স্লোভেনিয়াতে আসি কোনো দিন ভাবিনি জীবন থেকে সেরা সময়গুলো একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এখন আর বাবার সাথে কুরবানির হাটে যাওয়া হয় না। নিজের পছন্দ মতো পশু নির্বাচনের সুযোগ হয় না। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথেও একসাথে আর ঈদের নামাজে অংশ নেয়া হয় না। মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই, জর্দা, পোলাও এবং কুরবানির গোশতের স্বাদ এখন আর জোটে না। অতীতের সে সোনালি এখন কেবল স্মৃতি। সকল ধরণের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবকে বুকে চাপা দিয়ে এগিয়ে চলে প্রত্যেক প্রবাসীর জীবন।

রাকিব হাসান রাফি
দ্বিতীয় বর্ষ
ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা,
স্লোভেনিয়া।


আরো সংবাদ



premium cement