১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্যোগের ঘনঘটা পোশাক শিল্পে

পোশাক শিল্পে - সংগৃহীত

দেশে তৈরী পোশাকের উৎপাদন খরচ প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিপরীতে উৎপাদিত পণ্যের দাম না বেড়ে প্রতিনিয়ত কমছে। এ সময়ে প্রধান রফতানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পোশাকের দরপতন হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। ইউরোপে দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রা অবমূল্যায়ন হলেও বাংলাদেশে স্থিতিশীল রয়েছে। এসবের প্রভাবে দুর্যোগের ঘনঘটা বাজছে রফতানি বাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী দেশের সম্ভাবনাময় তৈরী পোশাক শিল্পখাতে। গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ১২০০ কারখানা। বন্ধের পথে রয়েছে আরো অনেকগুলো। বিপর্যয়কর পরিস্থিতির উত্তরণে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে নগদ সহায়তার পরিমাণ ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা। নিশ্চয়তা চান, আগামী ৫ বছর যাতে গ্যাসের মূল্য বাড়ানো না হয়।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে বিশ্বে পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৮ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, ক্রেতাদের চাহিদা কমেছে, যা মূল্যভিত্তিক বাজার প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। বিজিএমইএ গবেষণা সেলের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ এই চার বছরে এক হাজার ২০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকার কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা : এরই মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি। পূর্বাপর বিবেচনা ছাড়াই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বস্ত্র ও পোশাকখাতের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের প্রতিটি পোশাক কারখানাই ওয়াশিং ও ফিনিশিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত। আর ওয়াশিং কারখানাগুলোতে বয়লারের ব্যবহার হয়। আমরা মনে করি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবনা শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। কেননা, বস্ত্র ও তৈরী পোশাকখাতের সমান্তরাল প্রবৃদ্ধির সাথে এ দু’টি খাতেরই সমৃদ্ধি ও বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বলেন, কিছুদিন পর পর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। সরকারের কাছে আমাদের একান্ত অনুরোধ, শিল্পকে সহায়তা করার জন্য অনতিবিলম্বে একটি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করুন এবং এই নীতির মাধ্যমে রফতানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দিন। এমন কোনো পদক্ষেপ নিবেন না, যাতে করে শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ হয়, শ্রমিক কর্মসংস্থান হারায়, সর্বোপরি অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়ে। 

সরকার কথা রাখেনি : সদ্যবিদায়ী বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০১৮ সালে যখন পোশাকখাতে ন্যূন্যতম মজুরি বাড়ানো হয়, তখন আমাদের একান্ত অনুরোধ ছিল, ব্যয়ের ক্ষেত্রগুলো যতটা সম্ভব কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা। সরকারের পক্ষ থেকে তখন এ ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল কিন্তু তা পূরণ করা হয়নি। তিনি বলেন, তিতাস গ্যাস কোম্পানি তার শেয়ারহোল্ডারদের ৩৫ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে, অথচ আমরাতো ২ শতাংশও ব্যবসা করতে পারছি না। তিতাসের কাছে আমার প্রশ্ন, সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা কিভাবে এত মুনাফা দিতে পারে, যেখানে বলা হয় যে, ভর্তুকি নিয়ে তিতাস চলছে। আমরা মনে করি, বিইআরসি নির্ধারিত ভর্তুকি সরকার না দিলে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে অলস পড়ে থাকা অর্থ থেকে ঋণ নিয়ে বিতরণ কোম্পানিকে চালানো যেতে পারে। কিন্তু শিল্পকে ধ্বংস করে নয়। শিল্প থাকলে কর্মসংস্থান হবে, দেশের অর্থনীতি বেগবান হবে।

আগুনে ঘি ঢেলেছে টিআইবির প্রতিবেদন : নানান জটিলতায় পড়ে দেশের তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা যখন হিমসিম খাচ্ছিলেন, তাদের সেই তুষের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি প্রতিবেদন। গত ২৩ এপ্রিল প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, নতুন মজুরি কাঠামোতে তৈরী পোশাক শ্রমিকদের বেতন না বেড়ে বরং ২৬ শতাংশ কমে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে গ্রেড-১ শ্রমিকদের মূল মজুরি ছিল সাড়ে আট হাজার টাকা এবং গত জানুয়ারিতে ঘোষিত নতুন সংশোধিত মজুরি কাঠামোতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৩৮ টাকা। কিন্তু পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বিবেচনায় নেয়া হলে তা হতো ১৩ হাজার ৩৪৩ টাকা। অর্থাৎ, ইনক্রিমেন্ট যোগ না করায় বেতন দুই হাজার ৪০৫ টাকা কমে গেছে। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পোশাক শিল্পমালিকরা মজুরি বাড়ানোর নাম করে তাদের শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করেছেন। 
বিজিএমইএর প্রত্যাখ্যান : এ দিকে পোশাক শিল্পে সুশাসনের অপ্রগতি নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বিজিএমইএ বলছে, মাত্র ৮০টি কারখানাকে উদাহরণ ধরে সমগ্র শিল্পকে ঢালাওভাবে শিল্পকে হেয় করা কোনোমতেই কাম্য নয়। এ বিষয়ে বিজিএমইএর মতে, যেখানে ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা হলে ৫ বছর শেষে সামগ্রিক ইনক্রিমেন্ট এর হার দাঁড়ায় ২৭.৬৩ শতাংশ, সেখানে মজুরি বোর্ডকর্তৃক নির্ধারিত মজুরি কাঠামোতে মূল মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে শুরু করে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত। কারখানার অবকাঠামোগত খাতে নজর দেয়া হলেও শ্রমিকদের মূল্যায়নে কাক্সিক্ষত দৃষ্টি দেয়া হয়নি বলে টিআইবির দাবির উত্তরে বিজিএমইএ বলেছে, শ্রমিকের দক্ষতা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা মাসিক ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় না। যেখানে শ্রমিক দক্ষতা চীনে ৬৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৫৫ শতাংশ ও তুরস্কে ৭০ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশের শ্রমিকদের দক্ষতা মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে যদি টিআইবি ও বিজিএমইএ একসাথে কাজ করতে পারে, তাহলে এ ধরনের তথ্য বিভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব হবে বলেও আশা প্রকাশ করে বিজিএমইএ।

৫ শতাংশ প্রণোদনা দাবি : বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) নবনির্বাচিত সভাপতি ড. রুবানা হক এ প্রসঙ্গে বলেন, তৈরী পোশাক খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকারের সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক। তৈরী পোশাক খাতকে টেকসই করার পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাসের জন্য সঠিক নীতিমালা গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন, যথাযথ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার খুবই জরুরি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বজারে পোশাক খাতের পণ্যের মূল্য কমে যাওয়া এবং পোশাক খাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য ক্রেতার ক্রমাগত চাপের ফলে, বৈশ্বিকবাজারে আমাদের তৈরী পোশাক খাতের বাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য আগামী ৫ বছরের জন্য তৈরী পোশাক খাতের সব পণ্যের জন্য ৫ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেয়া জরুরি।

একমত বাণিজ্যমন্ত্রীও : উদ্যোক্তাদের দাবির সাথে একমত বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সীও। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রস্তাবিত প্রণোদনা একান্ত আবশ্যক। তিনি বলেন, বিভিন্ন বায়িং হাউজ এবং এজেন্সির মাধ্যমে পণ্য কেনার কারণে আমাদের তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তাবৃন্দ বিভিন্ন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে যথোপযুক্ত দাম পাচ্ছে না এবং ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানসমূহ যেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের নিকট হতে সরাসরি পণ্য ক্রয় করেন, সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিজিএমইএর প্রতি আহ্বান জানান। আমাদের অর্থনীতিতে তৈরী পোশাক খাত যেন আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সে লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ হতে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement