২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বহু পরিচয়ের একজন আলী যাকের

বহু পরিচয়ের একজন আলী যাকের -

একাধিক পরিচয়ের মানুষ তিনি। করপোরেট জগতের বস, সংগঠক এবং নাট্যব্যক্তিত্ব। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আলী যাকের ছিলেন একজন সফল মানুষ। যখন যে কাজে হাত দিতেন পূর্ণ মনোযোগ দেয়াই ছিল নেশা। একাগ্রতা থাকলে যেকোনো কাজে সফল হওয়া যায় সেটাও কর্মের মাধ্যমে বুঝিয়ে ছিলেন তিনি। মঞ্চে যখন আলী যাকের বিদ্রোহী নূরলদীন, রোমহর্ষে জেগে উঠতেন দর্শক। এ রকম নানা চরিত্রে অভিনেতা আলী যাকের বারবার ছিলেন নতুন। স্বাধীনতা-পরবর্তী মঞ্চনাটকের অন্যতম সংগঠক ও সফল নাট্যনির্দেশক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। সংস্কৃতিজগৎ ছাপিয়ে তার মেধা স্পর্শ করেছে বিজ্ঞাপনী খাতকে। একুশে পদকসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত মানুষটি শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে ফিরে গেলেন না ফেরার দেশে। হেরে গেলেন করোনাভাইরাসের কাছে। রেখে গেছেন তার অসংখ্য কর্ম ও সৃষ্টি।
আলী যাকেরের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে হলেও তার জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রামে। বাবা মোহাম্মদ তাহের ছিলেন চট্টগ্রামের সদর স্ট্রিটে এসডিও (তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর সেখানেই তার জন্ম। বাবা বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের চাকরির সুবাদে এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরতে থাকে তাদের পরিবার। আলী যাকের যখন কিছুটা বুঝতে পারেন তখন তাদের বাসা ছিল ফেনীতে। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি ফেনীর স্মৃতিচারণ করেছেন। ‘মনে আছে শহরটার কথা। মাঝখানে বিরাট দীঘি, চারপাশে সরকারি ভবন। একেবারে কোনায় যে বাংলোটা, সেটাই ছিল এসডিওর বাংলো। উঁচু ভিটার ওপর ছিল পাকা বাংলো। নিচে খড়ের গাদা। বড় ভাই, যাকে তিনি দাদা ডাকতেন, তিনি টারজান দেখতেন খুব। মুখে ‘আ আ’ শব্দ করে লাফ দিতেন। যাকের তা দেখতেন। একবার দাদা একটা কাঠের পাটাতন নিয়ে চারদিকে রিকশার বল-বিয়ারিং দিয়ে বানিয়েছিলেন দড়িটানা গাড়ি। বাংলোর সামনে পাকা রাস্তা দিয়ে চলত সে গাড়ি। তাতে শব্দ হতো ঘড়ঘড়। বাড়ির অদূরে বাঁধা ছিল এক ষাঁড়। ষাঁড় সে শব্দ পছন্দ করেনি। হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে পিছু নিলো ষাঁড়। দাদা পালালেন। যাকের চুপচাপ বসে আছেন গাড়িতে। গাড়ি চলছে না বলে তখন শব্দ নেই। ষাঁড় শব্দ না পেয়ে আবার আস্তে আস্তে চলে গেল।’ জীবনের প্রথম ভয়ের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে এই স্মৃতিচারণ করেছিলেন তিনি।
ফেনীর পর তাদের পরিবার স্থায়ী হয়েছিল খুলনায়। সেখানকার পিকচার প্যালেসে (পূর্বের নাম নীলা সিনেমা হল) দেখেছিলেন জীবনের প্রথম সিনেমা। তিনি বলতেন খুলনায় গিয়েই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা মজবুত হয়ে ছিল আমার। এরই মধ্যে বাবা হয়ে হয়ে গেলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। খুলনা ছেড়ে তখন চলে আসতে হয়েছিল কুষ্টিয়ায়। যে এলাকায় তারা থাকতেন, সেটা ব্রিটিশরা তৈরি করেছে। রাস্তার দুই ধারে কড়ইগাছ। তার ছায়ায় যাওয়া-আসা। ধানক্ষেত। এরপর খরস্রোতা গড়াই নদ। আলী যাকেরের ভাষায় জীবনের প্রথম বিস্ময়ের জন্ম হয়েছিল ওখানে। তাও আবার বড় ভাইকে ঘিরে। এরই মধ্যে বাবা পদোন্নতি পেয়ে হয়ে গেলেন প্রাদেশিক সরকারের সচিব। এবার গন্তব্য ঢাকা। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, সেবার ট্রেনের প্রথম শ্রেণীতে গোয়ালন্দ পর্যন্ত আসা। মায়ের এত দিনের সংসার, কত জিনিসপত্র। একটা ওয়াগনে সে আসবাবগুলোও চলল সাথে। গোয়ালন্দে এসে এমু নামের জাহাজ! তিন দিনে এ জাহাজ পৌঁছাবে নারায়ণগঞ্জ! পথে পথে থামছে এমু। কারও কাছ থেকে দুধ, ইলিশ মাছ, মিষ্টি কেনা হচ্ছে। সে এক এলাহি ব্যাপার। জাহাজের গোটা প্রথম শ্রেণীটাই ছিল তাদের দখলে, কিন্তু জাহাজের ডেকেই খাওয়া, ডেকেই ঘুম!
ঢাকায় প্রথমে অভয় দাস লেনে, তারপর গেন্ডারিয়ায়। কামরুন্নেসা স্কুল ছিল বাড়ির কাছেই। বেল বাজলেই এত মেয়ে বেরিয়ে আসে! এর আগে এ নিয়ে যাকের ভাবেনইনি কখনো। এই প্রথম নারীদের ব্যাপারে সচেতনতা আর আগ্রহের সৃষ্টি হলো তার। গেন্ডারিয়ার বাড়িটি কেনা হয়েছিল সাড়ে ষোলো হাজার টাকায়। সব মিলে হাজার বিশেক টাকা খরচ হয়েছিল। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডে হাত পড়েছিল বাড়ি কেনার সময়।
১৯৫৫ সালে বাবা ছেড়ে দিলেন সরকারি চাকরি। পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করলেন বাওয়ানি জুট মিলস আর বাওয়ানি টেক্সটাইলসে। অসুখ হলে তিনি হোমিওপ্যাথ সেবন করতেন। বুকে ব্যথা হলে মনে করতেন এটা গ্যাসের ব্যথা। একদিন অফিসের পথে তাকে বিদায় দিলেন পরিবারের সবাই। কিন্তু সে মানুষটা আর ফিরে এলেন না। ফিরল তার লাশ। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন মোহাম্মদ তাহের। সেটা ১৯৬১ সাল।
সেন্ট গ্রেগরি থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে যাকের ভর্তি হলেন নটর ডেম কলেজে, সেখান থেকে পাস করলেন ১৯৬২ সালে।
সংসার আর আগের মতো রইল না। বাড়ির নিচতলা ভাড়া দিয়ে পুত্র-কন্যা নিয়ে মা উঠে গেলেন দোতলার পৌনে দুই ঘরের বাড়িতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ড. সাজ্জাদ হোসেন পরিচয় করিয়ে দিলেন সমাজবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান জন ই ওয়েনের সাথে। বাংলা, ইংরেজি বা অর্থনীতি না পড়ে ওয়েন পরামর্শ দিলেন সমাজবিদ্যা (সোশিওলজি) পড়তে। সে বিষয়েই স্নাতক হলেন আলী যাকের।
তখন পর্যন্ত নাটকের ‘ন’ও জানেন না তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা মিলে একটা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা করেছিল। সেখানে যে ক’টি বিভাগে অংশ নিয়েছিলেন আলী যাকের, তার সব ক’টিতেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে যাওয়ার সময় শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তের বেশ ক’টি নাটক দেখেছিলেন তিনি। পরবর্তী জীবনে এই নাটক দেখার অভিজ্ঞতাই কাজে লেগেছিল তার।
মা চলে যান ১৯৬৪ সালে, দিদি ১৯৬৫ সালে। এক ভয় এসে ঘিরে ধরেছিল তাদের।
স্নাতক পড়ার সময়ই ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সে সময়ই ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থীÑএই দু’ভাগ হয়ে যায়। তিনি যোগ দিলেন মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নে।
অনার্স শেষ হওয়ার পর একদিন দাদা বললেন, ‘করাচি যাবি?’ গেলেন করাচি। কিছুদিন থাকার পর দেখলেন টাকা পয়সা শেষ হয়ে যাচ্ছে। লিখলেন চিঠি, ‘পয়সা ফুরিয়ে গেছে।’ দাদার উত্তর, ‘দুই শ’ টাকা পাঠাচ্ছি, এরপর নিজে কিছু করে জোগাড় করো।’ সে সময়ই ডন পত্রিকায় দেখলেন এক চাকরির বিজ্ঞাপন। ডন ক্রফোর্ডস বলে ব্রিটিশ এজেন্সিতে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ শুরু করলেন।
কত দিন আর ভালো লাগে! ফিরতে ইচ্ছা হলো ঢাকায়। সেই ডনÑ এই দেখলেন ফ্যান্সি গ্রুপের বিজ্ঞাপন। এশিয়াটিক বলে একটি কোম্পানির ঢাকা অফিসে লোক নেয়া হবে। তারা ছিলেন কমার্স ব্যাংক, আইপিএস, ক্রিসেন্ট জুট মিলসের মালিক। সেখানে ঢুকে ঢাকায় ফিরলেন।
১৯৬৯ সালে দেশে ফিরে এশিয়াটিকে চাকরি করছিলেন। সারা দেশ তখন উত্তাল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গেলেন। প্রশিক্ষণ নিলেন। কলকাতায় দেখা হলো চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবিরের সাথে। সৈয়দ আমির আলী এভিনিউয়ে। তিনিই বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ময়দানের যুদ্ধের মতোই জরুরি হলো প্রচারযুদ্ধ। বিশ্ববাসীকে বোঝাতে হবে আমরা ন্যায়যুদ্ধ করছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটা ইংরেজি সার্ভিস শুরু করছে, লেগে যাও।’ সেখানেই ছিলেন যাকের। প্রচারণা চালিয়েছেন। হয়েছেন শব্দসংগ্রামী।
নাট্যজন মামুনুর রশীদের সাথে ছিল ‘তুই’ সম্পর্ক। একদিন মামুনুর রশীদ বলছিলেন, ‘দেশে গিয়া কী করবি?’ আলী যাকের বলেছিলেন, ‘নাটক করুম।’ ঢাকায় আসার পর মামুনুর রশীদ একদিন বললেন, ‘তুই না কইসিলি নাটক করবি! ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক করুম।’
আমরা যে আলী যাকেরকে নিয়ে কথা বলছি, তিনি হচ্ছেন নাটকের এই আলী যাকের। আরণ্যকের কবর নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই তিনি নাট্যচর্চায় নিজেকে নিবেদন করেন। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে প্রথম অভিনয়। ২০ ফেব্রুয়ারি একটি আর ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ও সন্ধ্যায় দু’টি শো হয়েছিল নাটকটির। সকালের শো সরাসরি প্রচার করেছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেটা দেখেছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি জিয়া হায়দার আর সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান। তারা সন্ধ্যায় এসে আলী যাকেরকে নাগরিকে যোগ দিতে বলেন।
মামুনুর রশীদের সাথে কথা হয়। এ সময় আরণ্যেকর নতুন কিছু নেই, তাই মামুনুর রশীদও ‘না’ করেন না। ওই বছরেরই জুন মাসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেন আলী যাকের। তখন থেকে নাগরিকই তার নাটকসংক্রান্ত ঠিকানা।


আরো সংবাদ



premium cement