১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সঙ্গীত সংশ্লিষ্টদের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে উল্টো বিপদ

-

বাংলাদেশের ৫০ বছরের সঙ্গীত ইতিহাসে এবারই প্রথম কাছাকাছি সময়ে সংগঠিত হয়েছে সঙ্গীতের প্রধান তিন পক্ষ। গড়ে উঠেছে গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পীদের আলাদা সংগঠন। এর পেছনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশে কপিরাইট অফিস। বিশেষ করে কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বেগবান হয়েছে সঙ্গীতাঙ্গনের মেধাস্বত্ব ও রয়্যালটি আইনের গতি।
উদ্দেশ্য একটাই, কপিরাইট অফিসের সমর্থন নিয়ে সঙ্গীতাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো এবং বাংলাদেশে বিদ্যমান ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির স্বত্বের বিষয়ে শিল্পীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রচলিত রয়েছে, এসব বিষয়ে এর আগে দেশের কোনো কপিরাইট রেজিস্ট্রার এভাবে ডোর টু ডোর কাজ করেনি। একইভাবে নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সঙ্গীতশিল্পীদের এমন উদ্যমী হতেও দেখা যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, যে কয়েকটি পক্ষ সঙ্গীতস্রষ্টাদের ঠকিয়ে ‘লাভের গুড়’ ঘরে তুলেছে, তারাই এখন নানা মাধ্যমে প্রচার প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, জটিলতা সৃষ্টি করছে। শিল্পীদের মধ্যে তৈরি করতে চাইছে বিভেদ, বিতর্কিত করতে চাইছে কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরীকে।
অনেকেই মনে করছেন, কপিরাইট অফিস তথা রেজিস্ট্রারের চলমান কার্যক্রম বিতর্কিত করে তাকে যদি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া যায়, তবেই সফল হবে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাফর রাজা চৌধুরী বাংলাদেশ কপিরাইট রেজিস্ট্রার অফিসের দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৭ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ৫০০। এর মধ্যে সঙ্গীতের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। এরপর জাফর রাজা চৌধুরীর একক প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালে সে সংখ্যা বেড়ে হয় এক হাজার ৮০০। গত বছর সেটি বেড়ে হয় তিন হাজার দুই শতাধিক, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ধারণা করা হচ্ছে, এবার ২০২০ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়াবে দ্বিগুণ।
রাজার ভাষ্যে, ‘আমি এখানে দায়িত্ব পাওয়ার পর গ্রাফিক্স, পেইন্টিং, প্রকাশক, লেখক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতের সাথে যারা আছে, সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছি। পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি অনলাইনে নিয়ে এসেছি। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে অবাক লেগেছে গানের বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে। দেখলাম এখানে কপিরাইট করা ও রয়্যালটি আদায়ের বিষয়ে প্রচণ্ড সমস্যা রয়েছে। গীতিকার-সুরকাররা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমরা তো গানের জন্য কখনো রয়্যালটি পাই না।’ শুধু তা-ই না, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন, একটা গানের স্রষ্টা তার ইউটিউবে গান ওঠালে স্ট্রাইক খাচ্ছেন! বলা হচ্ছে, এই গান আপনার না! এসব দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। কারণ, এগুলো আমি জানতাম না। তো এই বিষয়টি আমাকে তাড়িত করে। কারণ, সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে এই বিষয়গুলো দেখার ও সমাধানের নৈতিক দায়িত্ব আমার। তাই আমি সঙ্গীত সংশ্লিষ্টদের সাথে প্রায় প্রতিদিন বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে থাকলাম। বিষয়গুলো সমাধান করার পথ দেখালাম। সবাইকে কপিরাইট বিষয়ে সচেতন করলাম। এভাবে তিনটি বছর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করলাম, আমার এসব উদ্যোগের কারণে অনেকের গাত্রদাহ হলো! বুঝলাম, শিল্পীদের অধিকার আদায় হোক, সেটা বুঝি অনেকে চাইছেন না। কিন্তু রাষ্ট্র আমাকে যে কাজটি দিয়েছেন, সেটি পালন না করাটাও তো আমার জন্য অপরাধ। এখানে আমি তো গীতিকার, সুরকার বা শিল্পী নই। আমার কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও নেই। ফলে আমার স্বার্থটার পুরোটাই রাষ্ট্রীয়। আমি রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী মাত্র।’
রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে চিঠি দিয়েছেন। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কপিরাইট অফিসে শিল্পীদের পক্ষ থেকে নানা কনটেন্ট ইস্যুতে অভিযোগ এসেছে। দেশের একমাত্র অনুমোদিত সিএমও বিএলসিপিএসের বিরুদ্ধেও রয়েছে শিল্পীদের নানা অভিযোগ।
শিল্পীদের দেয়া এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গিয়ে বর্তমান কপিরাইট অফিস ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ পেয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। মূল বিভেদের সূত্রপাত এখান থেকেই।
বাংলাদেশে কপিরাইট আন্দোলনকে বেগবান করার অন্যতম ব্যক্তিত্ব শিল্পী প্রীতম আহমেদ বলেন, ‘ভুয়া রয়্যালটি চুক্তির মাধ্যমে যারা ১০ বছর আমার ও শতাধিক শিল্পীর গানের টাকা মেরে দিয়েছে; তারাই এখন কপিরাইট রেজিস্ট্রারের বা আইনের বিরুদ্ধে নানাভাবে অভিযোগ করছে!
গীতিকবি ও সাংবাদিক কবির বকুল বলেন, ‘গীতিকার-সুরকারদের দীর্ঘ দিনের যে চাওয়া-পাওয়া সেটা যখন আলোর মুখ দেখা শুরু করল, তখনই কিছু বাধা আমাদের চোখে পড়ছে। এটা পৃথিবীর নিয়ম, কেউ ভালো কাজ করতে গেলে খারাপ ছায়া এসে পড়ে। কপিরাইট রেজিস্ট্রার এমনই একজন মানুষ, যিনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আমাদের বঞ্চিত শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরীর মতে, ‘উত্তরণের উপায় হচ্ছে মিউজিক্যাল বোর্ড গঠন করা। সেটি হলে এই জটিলতা কমবে। কপিরাইট ক্লেম বোর্ড নামে ভারতেও একটা প্রতিষ্ঠান আছে। আমেরিকাতেও একটা আছে। এতদিন মাঠটা খালি ছিল। গীতিকার, সুরকার, শিল্পীদের রিপ্রেজেন্টেশন ছিল না। ফলে রয়্যালটি নিয়ে সরকারের কাছে সঠিকভাবে তথ্য পৌঁছেনি। এখন সেই সুযোগটা সৃষ্টি হলো। মিউজিক বোর্ড গঠন করে সেখানে সব সংগঠনের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সঙ্গীতের মানুষগুলো সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকে ‘অসাধু হটাও’ আন্দোলন হিসেবে দেখছেন দেশের অন্যতম গীতিকবি ও সুরস্রষ্টা প্রিন্স মাহমুদ। তিনি চান কপিরাইট অফিসের সহযোগিতা নিয়ে এই সংগঠনগুলো সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাক। তার ভাষ্যে, ‘বিশ্বাস করি একজন শিল্পী হিসেবে আমি যে সংগঠনে থাকি, সেটিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করব না। সেটা যদি করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রতারক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকব। আমি আগামীকাল থাকব না, তবে আমার সন্তানরা থাকবে। তাদের সম্পর্কেও আমার চিন্তা করা দরকার। যদি আমি অন্যায় করি, অবশ্যই আমার সন্তানরা সেই পরিণতি ভোগ করবে। টাকাই সবকিছু না। আমাদের সময় এসেছে ইন্ডাস্ট্রি তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু করার।’
জানা গেছে, গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পীদের তিন সংগঠন এক হয়ে শিগগিরই যৌথ বিবৃতি ও দাবিনামা পেশ করবে কপিরাইট অফিসসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, এসব উদ্যোগের মাধ্যমে সুরাহা হবে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অনিয়ম আর বৈরী পরিবেশের।

এখানে আমি তো গীতিকার, সুরকার বা শিল্পী নই। আমার কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও নেই। ফলে আমার স্বার্থটার পুরোটাই রাষ্ট্রীয় : জাফর রেজা চৌধুরী, রেজিস্ট্রার, কপি রাইট অফিস

‘গীতিকার-সুরকারদের দীর্ঘ দিনের যে চাওয়া-পাওয়া সেটা যখন আলোর মুখ দেখা শুরু করল, তখনই কিছু বাধা আমাদের চোখে পড়ছে: কবির বকুল, গীতিকার

‘বিশ্বাস করি একজন শিল্পী হিসেবে আমি যে সংগঠনে থাকি, সেটিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করব না। সেটা যদি করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রতারক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকব : প্রিন্স মাহমুদ, গীতিকার ও সুরকার

 


আরো সংবাদ



premium cement