১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`

ডিসি-ওসিদের ভোট চাওয়া নিয়ে যত বিতর্ক

ডিসি-ওসিদের ভোট চাওয়া নিয়ে যত বিতর্ক - ছবি : সংগৃহীত

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করতে জনগণকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো: ইমরান আহমেদ।

তার এ বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘একজন ডিসি এমন বক্তব্য দিতে পারেন না।’

নির্বাচন কমিশন মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দিয়ে মো: ইমরান আহমেকে প্রত্যাহার করে সামনে নির্বাচনের কোনো দায়িত্ব না দেয়ার জন্য বলেছে।

পাশাপাশি কমিশন ওই চিঠিতে বলেছে, জেলা প্রশাসকদের এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকতে সতর্কবার্তা দেয়া প্রয়োজন।

জেলা প্রশাসকের বক্তব্যটি খতিয়ে দেখে সত্যতা পেলে প্রতিমন্ত্রী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও বুধবার দুপুর পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারের ‘উচ্চ মহলে’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেখান থেকে নির্দেশনা পেলেই এ বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের বক্তব্য একেবারেই নতুন কিছু নয়।

এর আগে, ১৫ আগস্ট জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শ্যামল চন্দ্র ধর আওয়ামী লীগকে ‘নিজের দল’ উল্লেখ করে আগামী নির্বাচনে দলকে জেতাতে কাজ করতে আহ্বান জানিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ২৫ আগস্ট তাকে ওই থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

বাংলাদেশে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে নির্বাচনের আগে এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে কেন?

সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো: শহীদ খান বলছেন, গণকর্মচারীদের এভাবে একটি দলের জন্য ভোট চাওয়া গুরুতর অপরাধ এবং এর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেই এ প্রবণতা বাড়ছে।

অন্যদিকে সাবেক যুগ্ম সচিব বিজন কান্তি সরকার বলেছেন, প্রশাসনের নিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য কিছু কর্মকর্তা এসব করার সুযোগ পাচ্ছেন।

বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো বরাবরই সরকারি প্রশাসনকে দলীয়করণের অভিযোগ করে আসছে সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারও এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে।

জামালপুরের ডিসি যা বলেছেন
জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভার নতুন ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে সোমবার বিকেলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সেখানকার সংসদ সদস্য ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম।

ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন জেলা প্রশাসক ইমরান আহমেদ। তার বক্তব্যের মধ্যে সাড়ে তিন মিনিটের একটি অংশের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

সেখানে ইমরান আহমেদ বলেছেন, ‘এই সরকার যে উন্নয়ন করেছে, সেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এই সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। এটা হবে আমাদের প্রত্যেকের অঙ্গীকার। উন্নয়ন হতে থাকবে, এই দেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।’

একই সাথে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম মন্ত্রী হয়ে জেলার ‘আরো উন্নয়ন করবেন’ বলে আশা প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসক।

তিনি বলেন, ‘এটা আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি, এটা হবে, ইনশাআল্লাহ।’

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর রক্তব্য
মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে ডিসি ভিডিওতে যা বলেছেন তা খতিয়ে দেখা হবে। নির্বাচন সামনে নিয়ে এখন একজন ডিসি এমন কথা বলতে পারেন না। তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে পাঠানো হয়।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, কেউ তার বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করেছে কি-না, সেটাও যাচাই করে দেখা হবে।

তিনি বলেছেন, ‘এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগ, বক্তব্য টুইস্ট করা যায়। ডিসির বক্তব্য খতিয়ে দেখার পর সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে বুধবার দুপুর পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি।

সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতি
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে সরকার দলের সমর্থক কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশাসন সাজিয়ে রেখেছে বলে বিরোধীরা সবসময় অভিযোগ করে আসছে। অবশ্য প্রশাসন নিয়ে এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়।

এর আগে বিএনপি আমলেও তখনকার সরকারি দলের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ ছিল।

এসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যেই গত কয়েক বছরে বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক বক্তৃতা বা কর্মকাণ্ড দিয়ে আলোচনায় এসেছেন।

চলতি বছরেই এক সিনিয়র সচিব নিজের এলাকায় গিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন। পরে তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলে সরকার তাকে ওএসডি করে।

মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব থাকাকালে খাজা মিয়া নড়াইলে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। বিসিএস ১০ম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের এ কর্মকর্তাকে পরে গত ১১ জুলাই ওএসডি করে সরকার।

তার আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার আলোচনায় এসেছিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকার সময়। তখন তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রতিবাদ জানাতে মিছিল করেছিল কক্সবাজারে একদল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী।

কবির বিন আনোয়ার পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসর নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত হয়েছেন।

এর আগেও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে শুরু করে সরকারি শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।

তবে এটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে কয়েকটি থানার ওসির বক্তব্য বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে।

শরীয়তপুরের সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়েছিল। যেখানে পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেনকে দলীয় স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছিল। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট ওই ঘটনা ঘটেছিল।

চলতি বছর ১৫ আগস্ট কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: ফারুক হোসেন অর্থমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১০ আসনের সংসদ সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালকে আবারো নির্বাচনে জয়ী করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি ‘মিনতি’ জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এর তিন দিন পরে তাকে ওই এলাকা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের এক শ্রেণির কর্মকর্তার এমন তৎপরতা উদ্বেগজনক। কারণ সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এভাবে রাজনৈতিক দলের কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই।

তিনি বলেছেন, ‘এটি আইন বিরোধী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব কর্মকর্তারা জানেন যে নির্বাচনের আগে তাদের এমন বক্তব্য কতটা খারাপ হতে পারে দেশের জন্য। কারণ এমনিতেই নির্বাচন নিয়ে আস্থার সঙ্কট আছে। সে কারণেই এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।’

কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য কেন?
বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা রাজনৈতিক বক্তব্য বা ক্ষমতাসীন দলের জন্য কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই ছাত্রজীবনে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

সাবেক যুগ্ম সচিব বিজন কান্তি সরকার বলেছেন, ‘এরা অনেকেই ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছে। এখন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে দলের জন্য। অথবা তারা হয়ত ভাবছে নির্বাচনের ফল অনুকূলে না এলে তারা বিপদে পড়বেন। এ কারণে হয়ত ঝুঁকিও নিচ্ছেন তারা।’

যদিও ডিসি পর্যায়ে এখন যারা কর্মরত আছেন তাদের অনেকেই সরকারের মন্ত্রীদের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যেও অনেকে সরাসরি ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

আবু আলম শহীদ খান বলেন, এসব কর্মকর্তারা তাদের ‘কন্ডাক্ট রুলস’ সম্পর্কে জানেন, যেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ তারা নিতে পারেন না।

অনেকে মনে করেন, কিছু কিছু কর্মকর্তা ‘অতি উৎসাহী’ হয়ে গত কয়েক বছর ধরেই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন এবং তারা মনে করেন আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় না এলে তাদের জন্য ‘সঙ্কটময় পরিস্থিতি’ তৈরি হতে পারে।

চাককিবিধি লঙ্ঘনের শাস্তি কী?
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ অংশে বলা আছে, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।

আবু আলম মো: শহীদ খান বলছেন, বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একটি গুরুতর অপরাধ।

তিনি বলেন, ‘তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি সব কিছু একটি নিয়মের আওতায় চলে। দলের মিটিংয়ে থাকাটাই তাদের জন্য অন্যায়।’

তবে বিজন কান্তি সরকার বলেছেন, সরকারি কোনো কর্মকর্তা কারো জন্য কোনো তদবির করতে পারবে না, রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবে না এবং কোনো উপহার নিতে পারবেন না। তাদের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। এখন সমস্যা হলো প্রশাসনের নিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যটাই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।’

তিনি জানান, কোনো কর্মকর্তা চাকরি বিধি লঙ্ঘন করলে বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তি স্বরূপ তার পদাবনতি হতে পারে, চাকরিচ্যুতি হতে পারে এবং এমনকি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও হতে পারে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement