র্যাগিংয়ের আতঙ্কে জবির নবীন শিক্ষার্থীরা
- মোছা: সাবিনা খাতুন
- ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৫৪

নবীনদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। তবে র্যাগিং নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে নবীন শিক্ষার্থীরা।
গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া ১৮তম ব্যাচের নবীনদের পৃথকভাবে বরণ করে নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ। ভর্তিযুদ্ধ শেষে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসা ওই শিক্ষার্থীরা র্যাগিংয়ের আতঙ্কে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, সিনিয়ররা তাদের ম্যানারস শেখানোর নামে র্যাগ দিয়ে থাকেন। এতে ক্লাস করতে ভয় পায় তারা।
এদিকে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেয়ার ঘটনায় সিনিয়র ব্যাচের (১৭তম ব্যাচ) সকল ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত রাখার অভিযোগ উঠেছে ইতিহাস বিভাগের বিরুদ্ধে।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানায়, পরিচয় পর্বের নামে সিনিয়ররা জুনিয়রদেরকে তাদের ফেসবুকে যুক্ত হওয়ার জন্য বাধ্য করে। এমনকি অনেক মেয়েকে মেসেঞ্জারে মেসেজ দেয়ার জন্য চাপ দেয়।
এছাড়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক নবীন শিক্ষার্থী জানান, তারা র্যা গিংয়ের শিকার হয়েছে। পরিচয় পর্বের নামে তাদেরকে র্যাগ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক জানান, জবি এখনো র্যাগিংমুক্ত হয়নি। তবে এর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে বলেন, ‘র্যাগিং নিয়ে এখানে জিরো টলারেন্স। অভিযুক্ত কেউ যদি প্রমাণিত হয় যে সে র্যা গ দিয়েছে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নেয়া হবে। তদন্তসাপেক্ষে শাস্তি হিসেবে বহিষ্কার ও জরিমানাও করা হতে পারে।’
ইতোমধ্যে ২৬ সেপ্টেম্বর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের দুই শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান (মেহেদী কাওছার) ও রাকিব মোল্লাকে (রাকিব ইসলাম ফারাবি) জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীদের র্যাগিং দেয়ার অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন এমন এক শিক্ষার্থী জানান, তাকে সালাম দেয়ার জন্য জোর করা হয়, যেখানেই দেখা হবে সিনিয়র সবাইকে এক এক করে সালাম দিতে হবে বলে বলা হয়।
জানা যায়, এর আগের বছরগুলোতেও ইসলামের ইতিহাস, বাংলা বিভাগ, গণযোগোযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ, সামাজিক বিভাগসহ আরো অনেক বিভাগেই র্যাগিং দেয়া হয়েছে।
আগের বছরে র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া এক শিক্ষার্থী জানান, ‘তার বাসা দূরে হওয়ায় তিনি বাসে আসা-যাওয়া করতেন। এ সময় এক সিনিয়র তার পরিচয় নেন। এরপর পরিচয়ে একটা তথ্য বাদ পরায় তাকে কলম দিয়ে পুরো বাস মাপতে বলে।
তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তাদেরকে নাচ, গান, অভিনয়, সিনিয়র ভাইদের প্রোপজ করা, ডাস্টার দিয়ে ক্লাসরুম মাপাসহ আরো অনেক ধরনের র্যাগ দেয়া হয়েছিল।
বর্তমানে র্যঅগিং এমন একপর্যায়ে চলে এসেছে, যা শুধু একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখলেই চলে না, এটি পুরোপুরি অপরাধ। এসবের ফলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবাগত শিক্ষার্থীরা যে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয় তাতে শুধু তাদের শিক্ষার্জনেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিরও কারণ হয়। দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন সময় নানারকম নির্মম র্যা গিংয়ের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় এবং স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর আগে একজন ছাত্রকে র্যাগিং দেয়ার নামে বৃষ্টির মধ্যে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। এতে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিষয়টি তখন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল।
এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজন নবীন শিক্ষার্থীকে র্যাগ দেয়ার উদ্দেশে কয়েকজন ছাত্র চড়-থাপ্পড় দেয় এবং নিজেরাই এর ভিডিও ধারণ করে, যা পরে বিভিন্ন সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়- বড় ভাইয়েরা তাদের জুনিয়রদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক ছাত্র র্যা গিংয়ের শিকার হয়ে মানসিকভাবে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে সে তার বাবা এবং চাচাকেও চিনতে পারেনি। র্যাগিংয়ের শিকার একজন শিক্ষার্থী শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। এমনকি তার পড়াশোনারও ইতি ঘটতে পারে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
এছাড়া কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্রী মোসাম্মৎ ফুলপরী খাতুন সিনিয়র ছাত্রীদের র্যাগিংয়ের ঘটনা বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। জানা গেছে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়াও তাকে বিবস্ত্র করে গায়ে সেফটিপিন ফোটানোর দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে রাখা হয়। এই র্যাগিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা।
ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্রী তাবাচ্ছুম দেখা করতে সংবাদ পাঠানোর পরও ফুলপরী খাতুন দেখা না করায় তাবাচ্ছুমের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। এরপর তারা সাত থেকে আটজন মিলে ফুলপরী খাতুনকে গণকক্ষে নিয়ে চড় থাপ্পড় মারতে থাকে, লাথি মারে, গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখে এবং একটা ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেয়।
এসব বর্বরতার ঘটনার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রলীগ তদন্ত করে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাকর্মীকে ছাত্রলীগ সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলেও পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আজীবন বহিষ্কার করা হয়।
তবে বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের মাত্রা এখন কমে গেছে। কারণ এখনকার শিক্ষার্থীদের দেয়া তথ্যমতে তাদের যে র্যাগ দেয়া হয়েছে তা ম্যানারস শিখানো, সালাম দেয়া, সিনিয়রদের সাথে ফেসবুকে যুক্ত হওয়া ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া এখানে হল না থাকায় ছাত্রদের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন র্যাগিং দেয়া যায়, তা হয় না। আর এখানকার একমাত্র ছাত্রীহলেও র্যাগিং দেয়া হয় না বলেও জানা গেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা