১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

'সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা জানতে নৃবৈজ্ঞানিক মাঠকর্ম'

'সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা জানতে নৃবৈজ্ঞানিক মাঠকর্ম' - ছবি : নয়া দিগন্ত

মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের তুলনামূলক অধ্যায়ন হলো নৃবিজ্ঞান। আর নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমের তাত্ত্বিক জ্ঞানকে প্রয়োগ করার একমাত্র ক্ষেত্র হল মাঠকর্ম। তাইতো স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ৃয়া ক্ষুদে নৃবিজ্ঞানীদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দু’বার মাঠে যেতে হয়। প্রথমবার দ্বিতীয় বর্ষে আর শেষবার স্নাতকোত্তরে। এরমধ্যে প্রথমবার মাঠে যেতে হয় নিছক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। যেই অভিজ্ঞতা একজন নৃবিজ্ঞানীকে গবেষণাকর্মে ভিত্তি তৈরিতে সাহায্য করে।

নৃবিজ্ঞানে মাঠকর্মের গুরুত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক মো: আইনুল হক বলেন, ‘নৃবিজ্ঞান মানুষকে নিয়ে অধ্যায়ন করে, মানুষের সংস্কৃতিকে নিয়ে অধ্যায়ন করে। সেই ক্ষেত্রে আমাদের ক্লাসরুমের বাইরে শেখার অনেক কিছু আছে’।

তিনি বলেন, মাঠকর্ম হচ্ছে নৃবিজ্ঞানের ল্যাব। মানুষের সংস্কৃতি ও বৈচিত্রতা সম্পর্কে জানতে হলে মানুষের কাছাকাছি যেতে হয়। তাই শিক্ষার্থীরা যেন একটু ভিন্নরকম পরিবেশে নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং ভবিষ্যতে গবেষণা কর্মে এগিয়ে যেতে পারে তাই এই মাঠকর্ম।

সম্প্রতি কুমল্লিা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৪তম ব্যাচ তাদের একাডেমিক কোর্সের অংশ হিসেবে মাঠকর্ম সম্পন্ন করেছে। ব্যাচের ৫৪ জন শিক্ষার্থীকে মোট নয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। যার প্রতিটি গ্রুপের সুপারভাইজার ছিলেন বিভাগের নয়জন শিক্ষক। গ্রুপগুলোর কাজের ক্ষেত্রও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেমন একটি গ্রুপের কাজ করার বিষয় ছিল বর্তমানে খাসিয়া নৃগোষ্ঠীদের ধর্মীয়, সামাজিক, ঐতিহ্যগত ও জন্ম-মৃত্যু সংক্রান্ত উৎসব গুলো কী এবং সেগুলো কিভাবে পালন করে তা জানা। পাশাপাশি কালের বিবর্তনে সেগুলো কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা দেখা এবং এই ব্যাপারে তাদের ভাবনা। এছাড়াও কিছু গ্রুপ এখনো মেডিসিন, খাসিয়াদের স্বাস্থ্য সন্ধানী আচরণ ও খাসিয়া ভাষার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে।

মোট নয়টি গ্রুপের চারটি গ্রুপকে পাঠানো হয় খাসিয়া পুঞ্জিতে এবং পাঁচটি গ্রুপকে পাঠানো হয় মণিপুরি পাড়ায়। খাসিয়া পুঞ্জিতে পাঠানো চারটি গ্রুপকেও আবার দু’ভাগ করা হয়। প্রথম দুটিকে পাঠানো হয় লাউয়াছড়ায় আবার পরের দুটি গ্রুপকে পাঠানো হয় মাগুড়ছড়ায়।

এর মধ্যেএকটি গ্রুপকে পাঠানো হয় লাউয়াছড়ায়। শুরুতেই তারা লাউয়াছড়ার হেডম্যানের অনুমতি নিয়ে পুঞ্জিতে প্রবেশ করেন। এরপর সবাই ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে এক তথ্যদাতা হলেন ৪৮ বছর বয়সী পুঞ্জির মন্ত্রী ফিলা পহ্তমি। দীর্ঘ ত্রিশ মিনিটের কথোপকথনে উঠে আসে খাসিয়াদের জীবনের নানা দিক। খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বিশ্বাসী। অর্থাৎ নারীরাই পরিবারের কর্তা। নারীদের কেন্দ্র করেই ব্যবসা বাণিজ্য আবর্তিত হয়। এমনকি বিয়ের পর দম্পতিকে থাকতেও হয় কনের বাড়িতে।

পুঞ্জির হেডম্যান জানান, তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম হল নিয়ামত্রি। যার অর্থ হল প্রকৃতি পূজারী। তারা একসময় প্রকৃতিকেন্দ্রিক নানা পূজাপার্বণে সময় পার করলেও বর্তমানে লাউয়াছড়ায় একটি পরিবার ছাড়া বাকি সবাই খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। তাই তাদের ধর্মীয় উৎসবেও এসেছে পরিবর্তন। এখন তারা ক্রিস্টমাস ও ইস্টারসানডেকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

এর বাইরেও তাদের ঐতিহ্যগত উৎসব শাডসুক মেনসিম (মনের সুখে নাচা), সেং কুটস্নেম (বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ী অনুষ্ঠান), বেডিংক্লাম (অশুভ শক্তি তাড়াতে ঘরের চালে বাঁশের ব্যবহার) সহ বিভিন্ন রকম উৎসব পালন করে থাকেন।

পুঞ্জির লোকেরা জানান, খাসিয়া সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর পছন্দের স্বাধীনতা। অর্থাৎ অবিবাহিত যুগল নিজেদের পছন্দ পরিবারকে জানালে তবেই তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। তবে পরিবার যদি অসম্মতি দেয় সেক্ষেত্রে পালিয়ে বিয়ে করার রীতিও সমাজে প্রচলিত রয়েছে।

তারা জানান, খাসিয়াদের প্রধান উৎসবগুলোতে লাউয়াছড়ায় একটিমাত্র পশু জবাই করে সবাই একত্রে ভোজনে অংশ নেন। এক্ষেত্রে যার যতটুকু সামর্থ তা নিয়েই উৎসবে অংশ নের সবাই। তবে খাবারের ক্ষেত্রে সকলেই সমান ভাগ পান। মূলত একটি মাঠে গোল হয়ে বৃদ্ধ কিংবা শিশু সবাই একত্রে ভোজনে অংশ নেন।

খাসিয়ারা জনান, তাদের সমাজে কেউ মারা গেলে তিনদিন তিন রাত তারা জেগে থাকেন। ওই সময়টায় তারা শোক কাটাতে ধর্মীয় গান-বাজনার আয়োজন করেন। কেউ কেউ লুডু-ছক্কা, তাস খেলেও সময় পার করেন।

পুঞ্জির হেডম্যান নিজেদের সংস্কৃতির নানা দিক বর্ণনার মাঝখানে আক্ষেপের সুরে তুলে ধরেন তাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগত দিকগুলো। তিনি বলেন, ‘আমরা মাতৃপ্রধান হলেও বর্তমানে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেরা বিয়ের পর কনের বাড়িতে উঠতে লজ্জাবোধ করে। এক সময় শাডসুক মেনসিমে কিংবা সেং কুটস্নেমে আমাদের ঐতিহ্যগত নৃত্য পরিবেশন করা হলেও বর্তমানে ছেলে-মেয়েরা আধুনিক নৃত্যে ঝুঁকে পড়েছে। এছাড়াও আমাদের শৈশবে বেডিংক্লাম পালন করা হলেও বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই বিষয়ে কিছু জানে না।

তবে আক্ষেপ-অভিযোগ কিংবা নৃত্য বাঙালি পর্যটকদের ভিড়ে অতীষ্ঠ হওয়া নিরীহ মানুষগুলো নৃবিজ্ঞানীদের সাধরেই গ্রহণ করেছিলেন।

তারা জানান, খাসিয়াদের একমাত্র আয়ের উৎস পানের পাইকারদের বসিয়ে রেখে সবার জন্য করেছেন চা-নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়। কয়েকজনকে উপহার হিসেবে দেয়া হয় পানের আঁটি। সবমিলিয়ে শিক্ষানবিশ নৃবিজ্ঞানীদের মাঠকর্মের এই স্মৃতি দীর্ঘদিন খাসিয়া নৃগোষ্ঠীর কথা মনে করাতে বাধ্য করার মতো।

শিক্ষানবীশ এ নৃবিজ্ঞানীরা জানান, দুই রাত কাটানো হীড বাংলাদেশের অপরুপ সৌন্দর্য্য এবং শেষদিনে ঘুরতে যাওয়া নয়নাভিরাম মাধবপুর লেইক বা 'লেইক অব দ্য লোটাস'র অপরুপ সৌন্দর্য্য এক সিন্দুক স্মৃতি হয়ে থাকবে তাদের।


আরো সংবাদ



premium cement
তেহরানের প্রধান বিমানবন্দরে পুনরায় ফ্লাইট চালু হামলায় কোনো ক্ষতি হয়নি : ইরানি কমান্ডার ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ‘কেন্দ্র’ ইস্ফাহান : সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা মিয়ানমারের বিজিপির আরো ১৩ সদস্য বাংলাদেশে রুমায় অপহৃত সোনালী ব্যাংকের সেই ম্যানেজারকে চট্টগ্রামে বদলি দুবাইয়ে বন্যা অব্য়াহত, বিমানবন্দর আংশিক খোলা ভারতে লোকসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু শুক্রবার সকালে ঢাকার বাতাস ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ শুক্রবার সকালে ঢাকার বাতাস ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ১৪ বছরেও হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়নি এসআই গৌতম রায়ের পবিবার মিলান-লিভারপুলের বিদায়, সেমিফাইনালে আটলন্টা-রোমা

সকল