২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শাবিপ্রবিতে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা

শাবিপ্রবিতে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা - ছবি : সংগৃহীত

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভিসির পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। সোমবার সকালে ক্যাম্পাসে তিন দফা দাবিতে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের প্রতিবাদে তারা ভিসির পদত্যাগ দাবি করেন।

এদিন সকাল থেকেই ‘যেই ভিসি গ্রেনেড ছোড়ে, সেই ভিসির পদত্যাগ চাই’, ‘যেই ভিসি ছাত্র মারে, সেই ভিসি চাই না’, ‘যেই ভিসি গুলি ছোড়ে, সেই ভিসির পদত্যাগ চাই’, ‘শিক্ষার্থীর ওপর হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’, ‘সাস্টিয়ান সাস্টিয়ান এক হও এক হও’ স্লোগানে ক্যাম্পাস উত্তাল করে তোলেন তারা।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হলেও যেকোনো পরিস্থিতিতে ভিসির পদত্যাগের আগে হল ছাড়বেন না বলে জানিয়েছেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা।

এমনকি তাদের ক্যাম্পাস ছাড়তে বলায় প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন। যতক্ষণ না ‘স্বৈরাচার’ ভিসি পদত্যাগ করছেন, ততক্ষণ আন্দোলনের মাঠে তারা অনড় থাকবেন বলেও জানান আন্দোলনরত একাধিক শিক্ষার্থী।

ভিসি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আলমগীর কবীর, ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবি করেন তারা।

ভিসিকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘তিনি (ভিসি) একের পর এক মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। আমরা আর এই ভিসিকে এক মুহূর্তও চাই না। তাকে শাবিপ্রবি ছাড়তে হবে।’

ক্যাম্পাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলের ফটকে ও প্রভোস্টদের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি কার্যালয়েও তালা দিয়েছেন তারা। তালা দেয়া হলগুলো হলো- বঙ্গবন্ধু হল, সৈয়দ মুজতবা আলী হল, প্রথম ছাত্রী হল ও বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী (দ্বিতীয় ছাত্রী হল)। শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

তবে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার পর সকালে অনেক শিক্ষার্থীকে হল ছাড়তে দেখা গেছে। ক্যাম্পাসে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য কড়া নজরদারি করছেন। তারা মূলত আতঙ্ক থেকে হল ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবন থেকে পুলিশ ভিসিকে উদ্ধার করার পর এখনো ক্যাম্পাসে পুলিশের সর্বোচ্চ উপস্থিতি রয়েছে। এসব কারণে আন্দোলন তীব্র থেকে আরো তীব্র হচ্ছে। ক্যাম্পাসে পুলিশের উপস্থিতি মেনে নিতে পারছেন না আন্দোলনকারীরা। তারা নানাভাবে স্লোগান দিয়ে পুলিশকে ক্যাম্পাস ছাড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। এই স্লোগানগুলোর মধ্যে একটি স্লোগান ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। স্লোগানটি হচ্ছে- ‘পুলিশ তুমি ফুল নাও, শাবি ছেড়ে চলে যাও’। এমন স্লোগান দেয়ার সময় উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের দিকে ফুল এগিয়ে দিতেও দেখা গেছে আন্দোলনকারীদের।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় গণিত বিভাগের অধ্যাপক ডা. রাশেদ তালুকদারকে প্রধান করে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রোববার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করে ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রোববারের ঘটনা খতিয়ে দেখতে এই কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য জহির বিন আলম বলেন, ‘রোববারের ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে, কারা দোষী, এটা আমরা খুঁজে বের করব। বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত ছিল, হঠাৎ কেন এমন অশান্ত হলো তা বের করা হবে।’

তবে ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন আন্দোলনে বহিরাগতরা অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পরও যারা আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে তাদের অনেকেই বহিরাগত।’

তিনি আরো বলেন, ‘রোববার রাত থেকেই ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা প্রবেশ করেছে বলে আমার কাছে তথ্য আছে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। তাদের ইন্ধনে শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। আজকের আন্দোলনের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তেমন সম্পৃক্ততা নেই।’

কিন্তু ভিসির এমন দাবি নাকচ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, ঘটনা ধামাচাপা দিতে মিথ্যাচার করছেন ভিসি। ক্যাম্পাসে পুলিশ ছাড়া বহিরাগত কেউ নেই।

ভিসির অভিযোগের বিষয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থী সৌরভ চাকমা বলেন, ‘রোববারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভিসি এমন কথা বলছেন। তারা (প্রশাসন) অভিযোগ করছে, বহিরাগতরা এসে গুলি চালিয়েছেন। কিন্তু সত্য হলো পুলিশ ছাড়া কেউ গুলি চালায়নি। পুলিশের গুলিতেই শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা আহত হয়েছেন। এখানে পুলিশ ছাড়া কেউ বহিরাগত নেই। পুলিশকে ভিসি ডেকে এনেছেন।’ তাদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে পুলিশ থাকবে কেন। তাদের এই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে হবে।’

শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির বিবৃতি

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলায় বিবৃতি দিয়েছে শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি। সোমবার বিকেলে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ মুহিবুল আলম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব নাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তাতে শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি স্তম্ভিত, মর্মাহত এবং লজ্জিত। নারকীয় এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা প্রহণের দাবি জানাচ্ছে শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি। এছাড়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের যারা আহত হয়েছেন তাদের সুচিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন নেতৃবৃন্দ।

সাবেক ৪৬৭ শিক্ষার্থীর বিবৃতি
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬৭ জন সাবেক শিক্ষার্থী। গতকাল গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুন্নেসা হলের (ছাত্রী হল) শিক্ষার্থীরা হলের অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রভোস্টের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে গেলে তিনি উদ্ধৃত ও অশোভন আচরণ করে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এতে ক্ষিপ্ত শিক্ষার্থীরা হলের অব্যবস্থাপনা নিরসন, প্রভোস্টের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। গত ১৫ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডির উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ কর্মীরা হামলা করে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এসে শাবিপ্রবি প্রশাসনের নির্দেশে নৃশংস কায়দায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমরা শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষার্থীরা এক প্রকার স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ্য করেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু হামলাই করেনি, তাদের ওপর জঘন্য কায়দায় শিক্ষক ও পুলিশের দিকে গুলি চালানোর মিথ্যা অপবাদও দিয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করার পাশাপাশি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।

উল্লেখ্য, প্রোভোস্ট জাফরিনের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা বৃহস্পতিবার রাত থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে তারা সরে যান। দাবি পূরণ না হওয়ায় শনিবার সন্ধ্যায় ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক আটকে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন। মধ্যরাতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরে গেলেও রোববার সকাল থেকে ফের শুরু হয় বিক্ষোভ। তাতে যোগ দেন সহপাঠীরাও।

এদিকে রোববারের জরুরি সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজা পদত্যাগ করেছেন, নতুন হল প্রভোস্ট হয়েছেন অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরী।

রোববার শিক্ষার্থীরা ভিসিকে ধাওয়া দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখলে পুলিশ উদ্ধারে যায়। পরে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হন। এ সময় টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ছুঁড়ে এবং লাঠিপেটা করে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপে পুলিশ‌ সদস্যেরাও আহত হয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement