২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছে স্কুল

ফুলকুড়ি স্কুলের পরিচালক তাকবীর আহমেদ - ছবি : সংগৃহীত

‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এখন কী করবো বলেন? মানুষ সন্তানের লাশ ফেলে দেয় না? এখন আমাকে ওটাই মনে করতে হবে - আমার সন্তান মারা গেছে, আমাকে এটা ফেলে রেখেই চলে যেতে হবে।’ স্কুল বিক্রি করে দেয়ার কথা বলতে গিয়ে এভাবেই নিজের মনের কথা তুলে ধরেন ফুলকুড়ি স্কুলের পরিচালক তাকবীর আহমেদ।

১৭ বছর ধরে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পড়াচ্ছিলেন তিনি। লকডাউনের কারণে আয় হয়নি, তাই ব্যয়বার বহন করতে না পেরে এখন স্কুল বিক্রি করে দিচ্ছেন তিনি।

তিনি বলেন, আমাদের স্কুরের যে সমস্ত অভিভাবক আছেন তাদের কেউ গার্মেন্টসে চাকরি করেন। কেউ বাসা-বাড়িতে কাজ করেন, কেউ ড্রাইভার। আমি কিন্তু জানি যে কার অবস্থাটা কী। এখন কিভাবে আমি গিয়ে বলি, ভাই আপনার বাচ্চার বেতনটা দেন। এর জন্য আমিও নিজের বিবেকের কাছে বন্দী।

এদিকে বাড়িওয়ালার ভাড়াও তো দিতে হবে উনি ঋণ করে বাড়ি করে দিয়েছেন আমাকে। চার মাস যাবত ভাড়া দিতে পারছি না। শিক্ষকরা ঘুরছেন, স্যার বেতনের কী হবে!

তিনি বলেন, প্রতি মাসে আমার এক লক্ষ টাকা স্কুলের পিছনে খরচ আছে। চারমাস চলে গেছে, আরো কত মাস চলবে, তার কোনো ধরাবাঁধা নেই। এটা কি এক মাস পরেই খুলে ফেলবে, নাকি আরো এক বছর বন্ধ রয়ে যাবে! আরো চার মাস বন্ধ থাকলে সেটা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ লাখ টাকায়। তখন তো এসব ফেলে রেখে আমাকে পালিয়ে যেতে হবে। অন্তত আত্মসম্মান নিয়ে এই স্কুলটা যেন ছাড়তে পারি, সে জন্যই বিক্রি করা।

ফুলকুঁড়ি স্কুলে প্রায় ২৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এই স্কুলের পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে.উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।

অনুপা আকতার নামের একজন অভিভাবক বলেন, মেয়েকে এই স্কুল থেকে পরীক্ষা দেয়াতে হবে ফরম ফিল-আপ বাকি আছে, নাম রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এখন কী করবো, কোথায় নিবো, কোথায় নিয়ে পরীক্ষা দেবে সেটাই তো খুঁজে পাচ্ছি না।

রিনা আকতার নামে অপর একজন অভিভাবক বলেন, এখানে আমার দুই মেয়ে পড়ে এখন কোথায় পড়তে পাঠাবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা না একটা কিছু তো করতে হবে।

আরেকজন অভিভাবক আরজু আকতার। তিনি বলেন, বড় স্কুলে পড়ানোর তো সামর্থ্য নেই ফুটপাতে বেচাকেনা করে যা পাই তাতে এখানে পড়ানোটা পোষাতে পারি।

সমস্যায় পড়েছে আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। স্কুলের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সহকর্মীদের নিয়ে মৌসুমী ফল বিক্রি করছেন ঢাকার আদাবরের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ আমিনা বেগম তামান্ন। তিনি বলেন, আমার প্রয়োজনে আমি রাস্তায় নেমেছি যেন আমার প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে পারি। আমার সন্তান আছে, তাদের মুখে যেন দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে পারি যেন খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারি।

তামান্ন বলেন, বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় স্কুল বিল্ডিয়ে পরিবার নিয়ে উঠেছেন তিনি। এখন যেহেতু আমি স্কুলের ভাড়াই দিতে পারছি না, তাহলে বাসা ভাড়া কীভাবে দিবো? তাই একটা জায়গায় চলে এসেছি, যাতে বাসা ভাড়াটা সাশ্রয় হয়। স্কুলের দুইটা কক্ষের বেঞ্চ এবং অন্যান্য আসবাব সরিয়ে সেখানে জিনিসপত্র রেখে সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে থাকছি।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদ সূত্র থেকে জানা গেছে, লকডাউনের কারনে সারা দেশের প্রায় ১০০ কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বন্ধ হয়ে আছে প্রায় ৫০ হাজার স্কুলের ৬ লাখ শিক্ষকের আয়।

অনেক স্কুল বিক্রির সিদ্ধান্ত হলেও ক্রেতাদের খুব একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রতিষ্ঠানটা আমার সন্তানের চেয়েও বেশি এতো যত্ন করে, এতো পরিশ্রম করে এটি তৈরি করেছি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এখন কী করবো বলেন? মানুষ সন্তানের লাশ ফেলে দেয় না? এখন আমাকে ওটাই মনে করতে হবে, আমার সন্তানে মারা গেছে। আমাকে এটা ফেরে রেখেই চলে যেতে হবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement