২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মহাসঙ্কটে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

মহাসঙ্কটে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান - নয়া দিগন্ত

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় গত ১৭ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকতে পারে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে টিউশন ফি আদায় করতে না পেরে চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোমধ্যে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন বন্ধ রেখেছে কিছু প্রতিষ্ঠান। সঙ্কট কাটাতে এর মধ্যে মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসের বেতন চেয়ে অভিভাবকদের কাছে এসএমএস পাঠিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। তবে অভিভাবকরা বলছেন, এই মুহূর্তে তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে টিউশন ফি। এ অবস্থায় সরকারের কাছে অনুদান এবং প্রণোদনা চেয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সংগঠনগুলো। এ দিকে সম্পূর্ণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ নিয়ে কোনো চাপ দিতে না পারায় উভয় সঙ্কটে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বলছেন, টিউশন ফি দিয়েই মূলত এসব প্রতিষ্ঠান চলে। শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন, ভবন ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক সব খরচের একমাত্র উৎস টিউশন ফি। সামনে ঈদ, মে মাসের বেতনের সাথে ঈদ বোনাসও দিতে হবে। এ অবস্থায় টিউশন ফি আদায় না করতে পারলে চলতি মাসের বেতন, ঈদ বোনাস দেয়া সম্ভব হবে না। এভাবে আর এক-দুই মাস চললে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার উপক্রম হবে বলে আশঙ্কা করছেন মালিকরা। করোনার এই ছুটিতে ১০৫টি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় আর্থিক সঙ্কটের কারণে শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠান মাস শেষে অর্ধেক বেতন দিচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ সঙ্কট মুহূর্তে তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছেন সরকারের শরিক দলগুলো। একই দাবি জানিয়েছে অভিভাবক এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ বিভাগের সচিব মো: মাহবুব হোসেন বলেন, বিশেষ দুর্যোগে সবাইকে সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। যতটুকু টিউশন ফি আদায় হলে শিক্ষক-কর্মচারীরাও বাঁচবে, ততটুকু যেন আদায় করা হয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি এমন পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, যেহেতু বেসরকারি উদ্যোগে এসব প্রতিষ্ঠান চলে তাই আমরা চাইলে তাদের চাপ দিতে পারি না।

এ দিকে করোনার কারণে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের কাছে প্রণোদনা চেয়েছে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মাধ্যমের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। এর মধ্যে ৩৯০ কোটি টাকা প্রণোদনা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। গত শুক্রবার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন টেকনিক্যাল এডুকেশন কনসোর্টিয়াম অব বাংলাদেশের (টেকবিডি) সভাপতি প্রকৌশলী আবদুল আজিজ ও সাধারণ সম্পাদক মো: ইমরান চৌধুরী স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়, শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা প্রদানে তারা সরকারি কোনো সহযোগিতা পায় না এবং কখনো পাওয়ার আবেদনও করে না। বর্তমানে কারিগরি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত ও অনুমোদনপ্রাপ্ত সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিশেহারা।

দেশের শিশু শিক্ষায় সহায়ক ভূমিকায় থাকা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা চেয়েছে কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ভূঁইয়া ও মহাসচিব মো: মিজানুর রহমান জানিয়েছেন কিন্ডারগার্টেনগুলোকে টিকিয়ে রাখতে আমরা প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আবেদন করে ৫০ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ চেয়েছি। নেতৃবৃন্দ আরো জানান, সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কিন্ডারগার্টেনের ছয় লাখেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। দেশে ৪০ হাজারের বেশি কিন্ডারগাার্টেনে এক কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

এই মহামারীতে সঙ্কটে রয়েছেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজের কয়েক লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান সঙ্কটে এক দিকে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কাছে পাচ্ছে না; অন্য দিকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও বেতন নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে স্কুলের বাড়িভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতা পরিশোধ ও তাদের পরিবার চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এমন মুহূর্তে সরকারকে পাশে থাকার অনুরোধ জানিয়েছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংগঠন ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমসাব)’। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে প্রায় ১০ লাখ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি। এমসাব এর আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার কাজী তাইফ সাদাত বলেন, প্রায় ১০ লাখ উচ্চশিক্ষিত লোক এই শিক্ষাব্যবস্থায় জড়িত।

এ দিকে দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ থাকা দেশের লক্ষাধিক কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-কর্মচারীরা উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন। ভাড়া ভবনে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠান এখন ঠিকমতো বাড়ি ভাড়াও দিতে পারছে না। এ অবস্থায় অনলাইনে ক্লাস নেয়ার অনুমতি এবং আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছে কোচিং সেন্টারগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব শ্যাডো এডুকেশন বাংলাদেশ (অ্যাসেব)। সংগঠনের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা মো: ইমাদুল হক (ই হক ) এই প্রতিবেদককে জানান, আমাদের দাবি থাকবে অবিলম্বে আমাদের সংগঠনটিকে অনলাইনে লাইভ ক্লাসের অনুমতি দেয়া হোক।

এ দিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করে এককালীন অনুদান অথবা স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। দলের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে মেনন বলেন, সরকার নিজেই বলছেন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকতে পারে। ফলে এ সময় ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন আদায় সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতনভাতা, ইউটিলিটি বিল কোনো কিছুই পরিশোধ করতে পারবে না, ঈদ বোনাস তো দূরের কথা। এ দিকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বছরের বেতন-ফি মওকুফের দাবি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। গত বুধবার সংগঠনের ঢাকা নগর শাখার সভাপতি রাফিকুজ্জামান ফরিদ ও সাধারণ সম্পাদক অরূপ দাস শ্যাম বিবৃতিতে আরো কিছু দাবি জানান।

প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে বেতন না দেয়ার নোটিশ দিয়ে পরে প্রত্যাহার : বর্তমানের পরিস্থিতিতে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষক, ডাক্তার ও কর্মচারীদের পূর্নাঙ্গ বেতন ও উৎসব বোনাস প্রদান করা হবে না বলে নোটিশ জারি করে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। গত শনিবার সংগঠনটির জরুরি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্তে সব অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের এপ্রিল মাসের বেতন যা মে মাসে দেয়ার কথা, তা মূল বেতনের ৬০ ভাগ প্রদান করার কথা বলা হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সব কর্মচারী তাদের শতভাগ বেতন পাবেন। অনুপস্থিত কলেজ স্টাফদের ৬০ ভাগ বেতন দেয়া হবে। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি এম এ মুবিন খান ও সাধারণ সম্পাদক ডা: মো: এনামুর রহমান (এমপি) সব বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এই নোটিশ প্রদান করেন। তবে এমন সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেন প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, কোনোভাবেই মেডিক্যাল কলেজের আয় কমে যাওয়ার কোন কারণ নেই। ছাত্রছাত্রী ভর্তির সময়ই যে এককালিন বড় অঙ্কের টাকা নেয়া হয় তা ব্যয় বহন করবার জন্যই। অবশ্য সমালোচনার মুখে গতকাল সোমবার এই নোটিশ প্রত্যাহার করে নেয় সংগঠনটি।


আরো সংবাদ



premium cement