২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শুধু আবরারকে হত্যা করেনি আকাশ, ভ্যান চালক বাবার স্বপ্নও শেষ করে দিয়েছে

শুধু আবরারকে হত্যা করেনি আকাশ, ভ্যান চালক বাবার স্বপ্নও শেষ করে দিয়েছে - ছবি : সংগৃহীত

আতিকুল হোসেন ভ্যান চালক। স্ত্রী আর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার তার। বড় ছেলে আকাশ হোসেন ছিলো অত্যন্ত মেধাবী। তার পড়াশোনার খরচ যোগাতে মানুষের কাছে হাত পেতেছেন। অথচ সেই ছেলেই কিনা দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হয়ে গেছে খুনি। আবরার ফাহাদ হত্যার খুনি। বুধবার (৯ অক্টোবর) বিকেলে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফাহাদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার আকাশ হোসেনের বাবা আতিকুল হোসেন বলছিলেন এসব কথা।

জয়পুরহাট জেলা সদরের দোগাছি গ্রামের ভ্যানচালক আতিকুল কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। যখন এসব বলছিলেন, তখন তিনি কাঁদছিলেন আর চোখ মুছছিলেন। আতিকুল হোসেন বলেন,‘ছোলক (ছেলেকে) বুয়েটে পাটায়ছিলাম ইঞ্জিনিয়ার বানাবার লা'গে। সবসুময়ত খোঁজ লিচি, ভালো আছে কি না। তার মা সবসময় কথা কচ্চিলো। ছোল খাছে কি না, ক্লাসেত গেছে কি না, কোনো সমস্যা আছে কি না— সব ব্যাপারে খোঁজখবর লিছি হামরা। ভ্যান চালায়ে অভাবের সংসারের খরচ জোগায়ছি। আকাশের মা হাঁস-মুরগি পালে, ডিম বেচে অক ট্যাকা পাটায়ছে। নিজেরা না খায়ে ওর লা'গে প্রতিমাসে ট্যাকা পাটায়। একন কী থেকে কী হয়ে গেল, বুজবার পাচ্চি না।’

আতিকুল হোসেন জানান, তার ছেলে আকাশ হোসেন (২১)। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ১৬তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সদস্য, এটা জানত না তার পরিবার। ছেলেকে রাজনীতি করতে বারবার নিষেধ করেছেন বলেও জানান তিনি।

আতিকুল জানান, তিনি জয়পুরহাটে ভ্যান চালান। তার রোজগারেই পাঁচ জনের সংসার চলে। আর তাদের অভাবের সংসারে আকাশ ছিল একমাত্র সুখ আর অভাব পূরণের স্বপ্ন। অনেক আশা নিয়ে তিনি ছেলেকে বুয়েটে ভর্তি করান। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আকাশ সংসারের হাল ধরবে। সেই স্বপ্নই ছিল তার ও তার স্ত্রীর।

আতিকুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, সেই স্বপ্ন শ্যাষ। এখন স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা, জীবনটাই বাঁচানো দায় হয়া পড়ছে। তাই পুরো পরিবারশুদ্দ দুশ্চিন্তায় চোকে-মুকে (চোখে মুখে) সব ঝাপসা দেকতিছি। তিনি বলেন, ছেলেকে বুয়েটে পাটায়ছিলাম ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। নিজে না খায়েও তার জন্য পত্যেক মাসে ট্যাকা পাঠায়চি। আর আইজ এই দিন দ্যাকা লাগলো।

আকাশের বাবা আরও বলেন, অনেক সময় ছেলে ফোন করে বলত, খাতা কেনার ট্যাকা নাই। তখন সংসারের বাজার বাদ দিয়ে তাকে ট্যাকা পাটাতাম বিকাশ করে। আর বাজার না করেই বাড়িত ফিরে আসি। বউ -বাচ্চারা জিজ্ঞেস করলে কতাম, ছেলেক দিচি, তাই বাজার করবার পাইনি। তখন সবাই চুপ থাকত। সেই ছেলে যে আরেকজন ছেলেক মারবে, তা ভাববার পাচ্চি না। ওক (আকাশকে) বারবরার কছি (বলছি), বাবা তুই রাজনীতি করিস না, মারামারি করিস না। হামাকোরে কষ্টের সংসার, পড়াশুনা শ্যাষ করে ভালো চাকরি করা লাগবি।

বাবা আতিকুল হোসেন জানান, আকাশ ছাড়াও আরও এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে তার। তারও লেখাপড়া করে— মেয়ে নবম, ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাদেরও পড়ালেখার খরচ চালাতে হয়। আকাশ বলত, ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব নেবে।

‘একন সবাই মিলে চোকে-মুখে আন্ধার দেকতিছি। অতচ হামার ছোল এতই ভালো আছিলো যে, পুরো জয়পুরহাট জেলার লোক তার সুনাম করিচ্চিল। ম্যাট্রিক-ইন্টারেত গোল্ডেন এ প্লাস প্যাছে। এলাকার মেলা মানুষ তার লেখাপড়ায় নিজেত থেকে সহযোগিতা করিছে,’— বলেন আকাশের বাবা।

আকাশের নানা ইউসুফ হোসেনও এসেছিলেন আদালতে। তিনি বলেন, আকাশের বাবার কোনো জমিজমা নাই। খালি বাড়িটা আছে। ভ্যান চালিয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া আর সংসার চালায়। ছেলের মেধা দেখে এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য— সবাই সহযোগিতা করতেন আকাশের বাবাকে। পরীক্ষার সময় ফরম পূরণের টাকা থেকে শুরু করে বই কেনা— যেকোনো প্রয়োজনে এলাকার লোকজন সাধ্যমতো সহযোগিতা করত। এভাবে একটা পর্যায়ে আকাশ যখন বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পান, গোটা এলাকাতেই খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল।

আকাশের নানা বলেন, আকাশ খুব শান্ত ছিল। কখন যে রাজনীতিতে জড়িয়ে এতটা হিংস্র হয়েছে, তা জানি না। এখন এই সময়ে কার কাছে যাব, ভেবে পাচ্ছি না। এজন্য কারও কাছেই যাইনি। টাকাও খরচ করিনি। আকাশের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তবে সেও কথা বলেনি, আমরাও বলিনি। আইন অনুযায়ী যা হবে তাই মেনে নিতে হবে— বলেন নানা ইউসুফ।

আকাশ হোসেন বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ১০০৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন। বুধবার এই প্রতিবেদক যান শেরে বাংলা হলে। হলে সামনে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের, যারা আকাশকে চেনেন।

বুয়েটের ১৬তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী বলেন, আকাশ ভর্তি হওয়ার পর অনেক শান্ত ছিল। মাস ছয়েক হবে আকাশ রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছে। রাজনীতি শুরুর পর হঠাৎ করেই সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হয়তো বড় ভাইদের খুশি করতে এবং সামনে পদ-পদবী পেতেই উছৃঙ্খলতা দেখাত।

গত সোমবার (৭ অক্টোবর) ভোরে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের সিঁড়িতে পাওয়া যায় আবরারের নিথর দেহ। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, আবরার ওই হলের ১০১১ নম্বর রুমের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। রোববার (৬ অক্টোবর) দিবাগত রাতে তাকে নিজের রুম থেকে ডেকে নিয়ে যান কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা। ওই হলেরই ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন তারা। এ ঘটনায় রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। ১৯ জনকে আসামি করে দায়ের করা ওই মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

এজাহারে দেখা যায়, আবরার হত্যা মামলার ১২ নম্বর আসামি আকাশ হোসেন। অন্য আসামিদের সঙ্গে তিনিও আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন— এ অভিযোগে মঙ্গলবার বিকেলে ডেমরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আজ তাকে আদালতে নিলে আদালত তার রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সূত্র ; সারাবাংলা


আরো সংবাদ



premium cement