১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
পানিশূন্য দেশের নদ-নদী

পরিবেশের বিপর্যয়

-

উজানে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি মিলছে না ভাটির দেশ বাংলাদেশে। নদ-নদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। কোনো কোনো নদীতে পানির ক্ষীণধারা। অথচ নিকট অতীতেও আমাদের প্রায় সব নদীতে পর্যাপ্ত পানির ধারা ছিল। শুকনো মৌসুমেও প্রবল স্রোত বয়েছে। নদীতে যেমন পুরো বছর পাওয়া যেত নানা প্রজাতির মাছ, তেমনি ওই পানি দিয়ে চলেছে সেচকাজ। অনেক নদী সব মৌসুমে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের নীতি নেয়ায় আমাদের পুরো দেশ মরুকরণের মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে নদীবেষ্টিত বাংলাদেশে জীবন-জীবিকায় আমল পরিবর্তন ঘটেছে। মৎস্যজীবীরা নদীতে মাছ না পেয়ে পেশা বদলাচ্ছেন। অনেকে জীবনযুদ্ধে হেরে শহরে ভাসমান জনস্রোতে মিশেছে। তবে সবচেয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করছে প্রাণপ্রকৃতিতে। এর ক্ষতিকর প্রভাব সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে বৈ কমবে না।
পরীক্ষামূলক চালু করা ফারাক্কা বাঁধ ভারত শতভাগ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ১৯৯৬ সালে করা গঙ্গাচুক্তিও আমলে নেয় না। শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার আগে গঙ্গার বাংলদেশী অংশ পদ্মা পানিশূন্য হয়ে যায়। একটি সহযোগী দৈনিকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এর প্রভাবে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো ধু ধু বালুচর। পদ্মার শাখা নদী গড়াইতে খননকাজ করা হয়েছে। কয়েক দফা খনন করেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বর্ষা গেলে নদীতে জেগে উঠে বালুচর। অন্যদিকে যশোরে কপোতাক্ষ এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মায় এখন পানির ধারা একেবারে ক্ষীণ। শুকনো মৌসুমে পানি না থাকায় দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ বন্ধ হয়ে গেছে। এর বিকল্প হিসেবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে শুকনো মৌসুমে ফসল ফলাতে হয়। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল প্রায় সব সেচ প্রকল্পের একই পরিণতি। এতে প্রাকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। বাড়ছে আর্সেনিকের প্রকোপ। নদীতে পানি না থাকায় এদিকে নিম্নাঞ্চলে ঢুকে পড়ছে সমুদ্রের লোনা পানি। এর আওতা প্রতি বছর বাড়ছে। সুন্দরবনও হুমকিতে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, সুন্দরী গাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। পানি আগ্রাসনে এ অঞ্চলে পানিচক্র বিনষ্ট হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পড়ছে। নালা বিল-ঝিল পুকুর সব শুকিয়ে যাচ্ছে। কিছু অঞ্চলে তাপদাহের মধ্যে পানিসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। রান্নার পানি সংগ্রহে মানুষকে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিতে হচ্ছে। গোসলের পানিও তারা পাচ্ছেন না। দক্ষিণে জালের মতো বিস্তৃত নদীগুলো যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল। এখন লঞ্চঘাটগুলো ধু ধু প্রান্তর। পানির অভাবে নৌযান চলাচলের সুযোগ নেই। বেশির ভাগ নৌপথ এখন পুরোপুরি নাব্যতা হারিয়েছে। ফারাক্কা ছাড়াও ভারত থেকে নেমে আসা প্রতিটি নদীর পানি উজানে নানাভাবে প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
দেশের সীমানা নির্ধারিত। অন্যদিকে নদীগুলো স্রষ্টার অপার দান। এগুলোর ওপর অধিকার রয়েছে সংশ্লিষ্ট সব দেশের মানুষের। একচেটিয়া পানি প্রত্যাহার করা হলে ভাটি অঞ্চলের মানুষ বঞ্চিত হয়। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী ভারত এটি করতে পারে না। তবে দুর্ভাগ্য হলো, এ নিয়ে আইনি প্রতিকার পেতে আমাদের সরকারের মধ্যে তাগিদ দেখা যায় না। এক তিস্তাচুক্তি নিয়ে ভারত সরকার আমাদের মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে। দেশটির সাথে আরো ৫৩টি নদীর পানির হিস্যা সুরাহা হয়নি। বোঝাই যায়, ভারত এভাবে শুকনো মৌসুমে আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে।
নদীর পানিপ্রাপ্তি করুণা নয়, অধিকার। ভারতের কাছে থেকে আমাদের এ অধিকার আদায়ে সবার সোচ্চার হওয়া জাতীয় কর্তব্য।


আরো সংবাদ



premium cement