১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
প্লাস্টিকে পরিবেশ বিপর্যয়

আইন আছে প্রয়োগ নেই

-

বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এর পরিবেশগত ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়টি সবার জানা থাকলেও সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ সবাই অবাধে এর ব্যবহার করছে। প্লাস্টিক হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট পলিমার। এটি রাসায়নিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তৈরি হয়। এটি নমনীয়, ক্ষয় প্রতিরোধী ও টেকসই। মাটি পানি, বায়ুমণ্ডল, বন্যপ্রাণী ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদে গভীর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
লক্ষণীয়, শুকনো খাবারের মোড়কজাত থেকে বাজারে পচনশীল মাছও পলিথিনের ব্যাগে করে ভোক্তার কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাজারে কাপড়চোপড় ক্রয় এমনকি ভারী পণ্য বহনেও এটি এখন ব্যবহার হচ্ছে। এভাবে ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহার পৃথিবীর কোনো দেশে হয় না। বিশ্বের মোট প্লাস্টিক দূষণের ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ বাংলাদেশে হয়ে থাকে। ফ্রি স্টাইলে উচ্চহারে এর ব্যবহারের পরিণতি আমরা উপেক্ষা করছি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এজন্য অচিরে আমরা বড় পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার হবো।
প্লাস্টিক দূষণে মরণদশা অবস্থা হয়েছে রাজধানীর আশপাশে প্রবাহিত নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এবং চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর। কলকারখানার রাসায়নিক ও মানুষের পয়ঃনিষ্কাশনের ওপর প্লাস্টিক বর্জ্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে পড়ছে। তবে দেশের অন্যান্য নদী ও জলাশয়ও এর শিকার হচ্ছে। মাটি ও বায়ুর ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১৫ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু এর ব্যবহার ৩ থেকে বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে। তবে ঢাকায় মাথাপিছু এর ব্যবহার প্রায় তিনগুণ ২৪ কেজি। রাজধানীতে প্রতিদিন ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর ৩১০ দশমিক ৭ টন ময়লার ভাগাড়ে, ৭৭ দশমিক ৫ টন খাল ও নদীতে, ১৭ দশমিক ৩ টন নর্দমায় ফেলা হয়। ২৪০ দশমিক ৫ টন রিসাইকেল করা হয়। সেই হিসেবে মাসে দুই হাজার ৩২৫ টন ও বছরে ২৭ হাজার ৯০০ টন বর্জ্য পানিতে যাচ্ছে। ঢাকায় জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ এটি। অন্য বড় শহরগুলোতেও একই কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া এটি মাটির গুণগত মান কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে বড় বড় ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামোর স্থায়িত্বের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। সারা দেশে এর উচ্চ ব্যবহার থাকলেও তার সঠিক পরিমাণ জানা যায় না।
ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (এইএনএফপি) প্রতিবেদন মতে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪০ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়। এমনকি ইউরোপে জনপ্রতি বছরে ১০০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। উৎপাদিত প্লাস্টিকের ১০ শতাংশেরও কম পুনঃব্যবহার করা হয়। এর ৭৫ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা হয়। প্রায় দুই কোটি টন বর্জ্য বিভিন্ন ধরনের জলাধারে মিশে যায়। ইতোমধ্যে মানুষের খাদ্যচক্রের মধ্যে প্লাস্টিক কণা ঢুকে পড়েছে। এর প্রভাবে মানুষের নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সামুদ্রিক মাছ ও পাখির শরীরে এর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্রে যে বিপুল বর্জ্য জমেছে তা অপসারণের কোনো উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সেই তুলনায় এর ব্যবহার বন্ধ বা সীমিত করতে বৈশ্বিক উদ্যোগ নেই।
আমাদের দেশে প্রথম ২০০২ সালে প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ তৈরি নিষিদ্ধ হয়। এ আইন প্রয়োগের পেছনে একটা প্রণোদনাও ছিল। পাটের ব্যবহার বাড়াতে ও এর চাহিদা সৃষ্টিতে আদালতের আদেশ কাজে লাগানো যেত। পাট পরিবেশবান্ধব ও দেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক। দেখা গেল উচ্চ আদালতের আদেশ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয়নি। মানুষ স্বল্প দাম ও সহজে ব্যবহারযোগ্যতার জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিকের ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে থাকে। আর এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিক আছেন; যারা এটিকে কাজে লাগিয়ে দেশে পলিথিনে সয়লাব করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতাও রয়েছে।
পরিবেশ রক্ষা করতে হলে এর ব্যবহার প্রথমে সীমিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটা সম্ভব হলে এ ক্ষতির কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সেটি অত্যন্ত জরুরি হলেও জোরালো সামাজিক উদ্যোগ এখনো নেই। সরকারের মধ্যেও এর তাগিদ দেখা যায় না।


আরো সংবাদ



premium cement