২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
ক্ষমতার দাপটের নগ্ন প্রকাশ

লাঞ্ছিত অপমানিত সাধারণ

-

ক্ষমতা প্রদর্শনের উদগ্র বাসনা জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। কে কত বড়; তা জাহিরে বেপরোয়া মনোভাব নগ্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। একটা শ্রেণী এতে এতটাই বাড়াবাড়ি করছে, সমাজ রাষ্ট্রে বাকি নাগরিকের ন্যূনতম সম্মান বজায় রাখাও অসম্ভব হয়ে উঠছে। পাড়া-প্রতিবেশী ও সরকারি অফিসে এর নির্লজ্জ প্রদর্শন চলছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বাদ যাচ্ছে না।
বগুড়ায় এক বিচারকের স্কুলপড়–য়া মেয়ে মায়ের পদবির জোরে অন্য সহপাঠীর চেয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে। তার এ অন্যায় কর্মে মা-ও সরেজমিন নিজের ক্ষমতা জাহির করেন। অন্য দিকে রংপুরের জেলা প্রশাসক এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই দু’টি ঘটনার প্রতিবাদ হয়েছে। দাপট দেখানোর এমন নজির সারা দেশে এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত প্রজাতন্ত্রের সেবকেরা এই বাড়াবাড়ি করছেন।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইসলামের মেয়ে পড়ে বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। ওই স্কুলের ছাত্রীরা নিয়ম করে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়– দেয়। এই বিচারকের মেয়ে মায়ের সরকারি উচ্চ অবস্থান দেখিয়ে রুটিন কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসে। তাই নিয়ে বিচারক মা সশরীরে স্কুলে হাজির হয়ে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। তিনি কয়েকজন অভিভাবককে হুমকি দেন, ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। অবস্থার চাপে কয়েকজন ওই বিচারকের কাছে মাফ চাইতে বাধ্য হন বলে অভিযোগ ওঠে। বগুড়ার ওই বিচারককে সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এই নারী বিচারকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হয়নি। বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের সাথে বৈঠক করেন। ছাত্রীরা দাবি জানায়, ওই বিচারককে ভুক্তভোগী অভিভাবকের কাছে মাফ চাইতে হবে। এ ধরনের ক্ষমতার দাপট পুলিশ, প্রশাসন এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগের ব্যক্তিদের মধ্যে প্রকাশ্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুখের অভিযোগটিও মাঠপ্রশাসনের এক আমলার ক্ষমতার দম্ভের বহিঃপ্রকাশ। তিনি ব্যক্তিগত একটি কাজে রংপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক তাকে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ উমর ফারুখের। পরে তিনি নিজের মেয়েকে নিয়ে এর প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জেলা প্রশাসক নিচে নেমে এ ধরনের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা বড়ত্ব ভাব প্রদর্শনের অপচেষ্টা সমানে দেখা যাচ্ছে। এতে সাধারণ নাগরিকরা প্রায়ই অপমান লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। পুলিশ প্রশাসন ও বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর লোকজন এ ধরনের ঘটনা আরো বেশি ঘটাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি প্রশাসনের কারণে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হলে এ ধরনের একটি ঘটনার পর, দ্বিতীয়টি সংঘটিত হওয়ার কথা নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের জাতীয় জীবনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে।
লক্ষণীয়, বগুড়ার বিচারককে প্রত্যাহারের মাধ্যমে সেখানে সৃষ্ট ঘটনাটি পাশ কাটানোর নামান্তর বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দরকার ছিল ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া। সত্যিই যদি ওই বিচারক ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, তাহলে তার যথোপযুক্ত প্রতিকার হওয়া উচিত। এটিই ন্যায়বিচার। কিন্তু প্রত্যাহার করায় যারা সেখানে তার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন বলে অভিযোগ উঠেছে; তারা এবং স্কুলের শিক্ষার্থীরা এর কোনো বিচার পেল না। শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড বিক্ষোভ হওয়ায় শুধু বদলি করা হয়েছে; অন্যথায় তা-ও হতো বলে মনে হয় না। এদিকে রংপুরের জেলা প্রশাসক তখনই দুঃখ প্রকাশ করলেন; যখন সেখানে একটি প্রতিবাদী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এটাও কোনো সমাধান নয়। আমরা মনে করি ছোট বড় প্রত্যেকটি অপরাধের যুক্তিসঙ্গত প্রতিকার হতে হবে। অন্যথায় জনমনে সৃষ্ট বঞ্চনার ক্ষত থেকে যাবে। এর বহিঃপ্রকাশ কখন কিভাবে ঘটবে তা বলা মুশকিল।


আরো সংবাদ



premium cement