২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় সততা নেই

রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দরকার

-

রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থান ছলচাতুরীর বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি কিংবা নতুন কোনো চাপে পড়লে তারা এ ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহ দেখায়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেল, মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসে। বাস্তবে কিছু ভণিতা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিজেদের বাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় সামান্যতম অগ্রগতিও নেই, তারা আগের অবস্থানেই আছে। মিয়ানমার মূলত স্বীকার করতে চায় না নিজ দেশের পুরো একটি জাতিগোষ্ঠীকে। এ ধরনের অসততাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অবস্থানের পরও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বরাবর তাদের এই কূটকৌশলের মাধ্যমে সময় ক্ষেপণের আলোচনায় সায় দেয়। মিয়ানমারের সাথে এ ধরনের সর্বশেষ আলোচনার পর শরণার্থীসংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা এই দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় জড়িত হবে না।
মিয়ানমার নতুন করে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। ১৫ মার্চ নাফ নদী পেরিয়ে ২২ সদস্যের দলটি টেকনাফে পৌঁছালে তাদের স্বাগত জানানো হয়। কক্সবাজারে নিযুক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের নেতৃত্বে একটি দলের সাথে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের আলোচনা হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু যতটুকু জানা যাচ্ছে, তা হলো- রোহিঙ্গা দম্পতিদের বাংলাদেশে অবস্থানকালীন ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান। অথচ দেশটি মাত্র ৬০ হাজার দেশহারা রোহিঙ্গাকে তাদের দেশের অধিবাসী হিসেবে স্বীকার করে। যেখানে বাংলাদেশ তাদের আট লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দিয়েছিল যদিও এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গার সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। কেবল ২০১৭ সালে ভয়াবহ উৎখাত অভিযানের সময় ১২ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
ইউএনএইচসিআর বিবৃতিতে জানিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ রাখাইনে নেই। তাই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় পাইলট প্রকল্প নিয়ে আলোচনায় তারা সম্পৃক্ত নয়। রোহিঙ্গা নাগরিকের পূর্ণ মর্যাদায় নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার অবস্থানে বৈশ্বিক সংস্থাটি এখনো অটল রয়েছে। তারা বলেছে, শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে; তবে এ ব্যাপারে জোর করা যাবে না। নিজেদের আগের অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে তারা আরো জানায়, শরণার্থীদের পূর্ববর্তী বাসস্থান যাচাই করে নেয়ার জন্য তারা এখনো উভয় দেশকে উৎসাহিত করে। সে জন্য যত কারিগরি সহায়তা দরকার সেটি তারা দেবে। বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজেদের ইচ্ছায় ও সব রকম তথ্য জানার পর নেয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রত্যাবাসনের অধিকার বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সাথে কাজ চালিয়ে যাবে।
মিয়ানমার বরাবর সামান্য কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চায় তাদের নির্মিত কিছু ক্যাম্পে। এগুলোতে স্বাধীনভাবে বাঁচা যাবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত বসতিতে আগেও রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে আটক করে রাখার নজির রয়েছে দেশটির। নিজ দেশের অধিবাসীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাদের যে কোনো আগ্রহ নেই, সেটি স্পষ্ট বোঝা যায়। রাখাইন প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে তাদের উৎখাত করা হয়েছে। প্রথমে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। পরে তাদের আবাসভূমিকে পরিকল্পিত উপায়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি যাতে আর শনাক্ত করা না যায়, সেই ব্যবস্থা তারা অনেক ক্ষেত্রে করেছে। এসব ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য মিয়ানমারকে টেবিলে বাংলাদেশ আনতে পারে না। বরাবর তারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এখন খুচরা যে আলোচনা করছে তার লক্ষ্য, ওইসব ঘিঞ্জি ক্যাম্পে সামান্য একটি অংশকে ফিরিয়ে নেয়ার। অথচ তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে দেয়ার বিষয়টি সামনে আসেনি। তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য এটি একটি মৌলিক বিষয়। আগে তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টির ফায়সালা হতে হবে। মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। একজন মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত ইউএনএইচসিআর সে জন্য উদ্বিগ্ন। তারা চায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদে দেশে ফিরে যাওয়া। এ বিষয়টিতে বাংলাদেশেরও আন্তরিক হওয়া উচিত। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফাঁদে না পড়ে এর একটি টেকসই সমাধান নিয়ে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে বাংলাদেশকে।


আরো সংবাদ



premium cement