২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

মানসম্পন্ন শিক্ষা যেখানে অনুপস্থিত

-

একটা সময় ছিল, বিশেষ করে গত শতকের আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে বিপুল শিক্ষার্থী পড়ালেখার জন্য বিদেশে যেত। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো। এ প্রবণতা নব্বইয়ের শুরুতে আরো বেড়ে যায়। এর কারণ ছিল, দেশে তখন প্রয়োজনের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। তাই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হতো না।
উচ্চশিক্ষার এ সমস্যার সমাধানে দেশে ১৯৯২ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ানো ও বিদেশে শিক্ষার্থীদের চলে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা। এখন পর্যন্ত দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। শুরুর দিকে গ্রহণযোগ্য উদ্যোক্তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন। এতে দেশে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, যেগুলোতে পড়াশোনার মান বজায় রয়েছে। অবশ্য পরবর্তীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে, যা এখনো চলছে।
একটি সহযোগী দৈনিকের এক প্রতিবেদনে উল্লেøখ করা হয়েছে, অন্তত ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ বছরের বিভিন্ন সময়ে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সব ক’টিই বিভিন্ন মাত্রায় অনিয়ম পাওয়া গেছে। যার বিপরীতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে। আরো কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে ইউজিসি জানিয়েছে।
কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ও পরিবেশ এত দুর্বল যে, এমনো দেখা গেছে- দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ ও অন্যান্য সুবিধার জন্য জায়গা আছে মাত্র ১০ হাজার বর্গফুট। যদিও আইন অনুযায়ী, একটি সাময়িক অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি বিভাগ থাকতে হবে এবং জায়গা থাকতে ২৫ হাজার বর্গফুট। এমন উদাহরণও আছে, ছয় বছর ধরে চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দু’টি বিভাগ খুলতে পেরেছে। এসব নিয়ম না মানলেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি চলছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে উচ্চহারে ছাড় দেয়া হয়।
বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন শিক্ষাকার্যক্রম চলছে; তা বোঝা যায় ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত করতে গিয়ে ইউজিসি দেখতে পায়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন ৯ হাজার থেকে সাড়ে ২৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে প্রভাষকদের শুরুতে বেতন ২২ হাজার টাকা। সহকারী অধ্যাপকদের সাড়ে ২৯ হাজার, সহযোগী অধ্যাপকদের সাড়ে ৩৫ হাজার ও অধ্যাপকদের ৪৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- সাকুল্যে ২২ হাজার টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পড়ানোর মতো শিক্ষক পাওয়া আদৌ সম্ভব কি না? অথচ উচ্চশিক্ষা একটি বিশেষায়িত বিষয়। এ পর্যায়ে যারা পড়ান, তাদের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এত কম বেতন দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য আসলে ব্যবসায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা বিরাজমান।
উল্লিøখিত এসব তথ্য জেনে এ কথা বলা অসঙ্গত নয়, শিক্ষক সংখ্যা একেবারে অপ্রতুলতা, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, গবেষণা না হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি অনুপস্থিত। এর সাথে রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে একাধিক মামলা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির অভিযোগ।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বেশ কিছু নিয়ম-কানুন আছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো- কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে তা মানা হয়, বেশির ভাগই তা মানে না। ইউজিসি এসব নিয়ম-কানুন মানতে পারছে কি না, সেটিও একটি প্রশ্ন। তাই শিক্ষাবিদদের মতো আমরাও মনে করি, রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইউজিসির উচিত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সার্বিক মান বজায়ে রাখতে পারবে না, সেগুলোর অনুমোদন বাতিল করা।


আরো সংবাদ



premium cement