২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক ফাঁস করছেন প্রশ্ন

দুর্নীতি এখন জাতীয় রোগ

-

অন্যায় অপকর্মকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার প্রবণতা আমাদের সর্বনাশ করেছে। বিশেষ করে বিগত এক যুগে যখনই জাতির সামনে কোনো সমস্যা হাজির হয়েছে সরকার সেটিকে আলাদা একটি বিষয় হিসেবে শনাক্ত করে সমাধান করার চেষ্টা করেছে। এভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাধান পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে সেটি আরো বড় বিপর্যয় নিয়ে হাজির হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতির মহামারী চলছে এখন। জাতির মেরুদণ্ড গড়ার ক্ষেত্র শিক্ষাতেও সমানতালে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। খোদ শিক্ষকরাই এতে জড়িয়েছেন। একপর্যায়ে সব ধরনের পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস সাধারণ ঘটনা হয়ে যায়। নানা ধরনের চেষ্টা তদবিরের পর বোর্ড পরীক্ষায় কয়েক বছর ধরে প্রশ্ন ফাঁস দেখা না গেলেও এ বছর দেখা যাচ্ছে- এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন আবারো ফাঁস হয়েছে।
খোদ প্রশ্নপত্র সংরক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক কেন্দ্র সচিব নিজেই এটি করেছেন। এমনকি তিনি সাধারণ কোনো শিক্ষক নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। এ বিষয়গুলোকে আমরা যদি আবারো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি, তাহলে সঙ্কট থেকে আমাদের নিস্তার মিলবে না। এটি মূলত একটি জাতীয় রোগ। আমাদের মধ্যে নীতি ও আদর্শের যে খরা চলছে তারই প্রকাশ। এ থেকে জাতীয় মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। অন্যথায় এর প্রভাব শুধু সহজে পরীক্ষায় পাসের মধ্যে সীমিত থাকবে না। ইতোমধ্যে প্রশ্ন ফাঁস ও নকল করে ভালো ফল অর্জনের নেতিবাচক প্রভাব জাতীয়ভাবে আমরা লক্ষ করছি। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ছাত্ররা উচ্চশিক্ষায় এসে আর ভালো করতে পারছে না। এমনকি পেশাজীবনে এসেও তার প্রভাব থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে উপযুক্ত কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। এই অভাব পূরণ করতে হচ্ছে বিদেশ থেকে কর্মী এনে যেখানে সারা দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বহু। সেই সাথে তাদের জন্য গুনতে হচ্ছে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা।
ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতে। দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে এসএসসির চলমান পরীক্ষায় কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমানসহ একটি চক্র সাতটি প্রশ্ন ফাঁস করেছে। এ ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়ার কারণে তিন শিক্ষক গ্রেফতার হয়েছেন। আরো কয়েকজনকে সহযোগী দেখিয়ে মামলা হয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের স্থানীয় আরো কিছু ব্যক্তির যোগসাজশের কথা উঠলেও তাদের আসামি করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। খবরে জানা যাচ্ছে, সারা দেশে পরীক্ষা সম্পাদনে অনিয়ম হচ্ছে। কেন্দ্রের বাইরে শান্ত পরিবেশ; কিন্তু ভেতরে শিক্ষকদের সহায়তায় চলছে নকল। ভুল প্রশ্ন বিতরণ করার কারণে পরীক্ষা বাতিলসহ আরো বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করেছিল। অথচ শিক্ষার্থীদের কাছে পাওয়া প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখা যায়, মূল প্রশ্নের সাথে সেগুলো হুবহু মিলছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের কপিসহ অন্যান্য প্রমাণ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আর অস্বীকার করতে পারেনি। এ ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ জন্য চারটি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। অথচ সময়মতো ব্যবস্থা নিলে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যেত। ছাত্রদের ভোগান্তিতে পড়তে হতো না।
এ দিকে ঘটনার পর শিক্ষা সচিব বলেছেন, ‘কাউকে না কাউকে দিয়ে কাজ করাতে হবে। আমি কার ওপর বিশ্বাস রাখব?’ মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক। অথচ এই শিক্ষক নিজ উদ্যোগে জড়িয়ে পড়লেন অমার্জনীয় এ অন্যায় কর্মে। প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, ফাঁসচক্র একটি প্রশ্ন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি জাতীয় রোগ। যেকোনোভাবে অর্থ কামানোর লিপ্সা থেকে এটি হচ্ছে। এমন প্রবণতা ঠেকাতে হলে অন্যায় প্রবণতার বিরুদ্ধে জাতীয়ভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। বাছাই করে কিছু লোককে বিচ্ছিন্নভাবে শাস্তি দিলে হবে না; গ্রহণ করতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক অভিযান। যেনতেনভাবে অর্থ কামাইকে ঘৃণিত কর্ম হিসেবে সমাজে হাজির করতে হবে। তবেই মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়া এমন দুর্নীতি অপকর্ম থেকে জাতি রেহাই পাবে।


আরো সংবাদ



premium cement