১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ

স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠিত হোক

-

বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার, পরিবারগুলোর বিচার পাওয়ার অধিকার অব্যাহতভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। আমাদের প্রশাসন এ ধরনের জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। তারা রাষ্ট্রের নাগরিকদের দুঃসহ করুণ অবস্থাকে শুধু অস্বীকারের মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছেন দীর্ঘ দিন। কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকেরা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে উপহাস করে এর ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখার প্রয়াস চালিয়েছেন। অন্য দিকে, আমাদের নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি। এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরামর্শকে সরকার অগ্রাহ্য করে ইস্যুটিকে চেপে রাখার চেষ্টা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট এ ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেছেন।
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন বিষয়টি সরেজমিন তদন্তে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছে। দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা ও ভুক্তভোগীদের উপর্যুপরি আহ্বানের পরও বেশ কয়েকবার মানবাধিকার সংস্থার আগমন সরকার কৌশলে এড়িয়ে গেছে। মিশেলের এবারের আগমন সেই প্রচেষ্টার অংশ। চার দিনের সফরে তিনি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও ভুক্তভোগী পরিবারের সাথে বৈঠক করেছেন। তিনি গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ নিয়ে সরকারের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে এতদিন উপেক্ষা করা ভুক্তভোগীদের দাবির প্রাথমিক স্বীকৃতি মিলল।
সফর শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মিশেল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো কিভাবে সুরাহা হবে তারও পরামর্শ প্রস্তাব করেন। এতে তিনি বিশ্বাসযোগ্য স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে ভুক্তভোগীরা রাষ্ট্রের কোনো পর্যায় থেকে এতদিন সহযোগিতা পাননি। তাই তদন্তটি এমন একটা পর্যায় থেকে হওয়া দরকার যেখানে গুম ও খুনের শিকার পরিবারগুলো নির্বিঘেœ তাদের অভিযোগ দায়ের করতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখার জন্য নিযুক্ত কমিটিও যেন কোনো ধরনের চাপে না পড়ে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলগুলো জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে এ ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানায়। মিশেল উল্লেখ করেন, অনেক অভিযোগের জন্য র্যাবকে দায়ী করা হয়েছে। এসব ঘটনায় জবাবদিহির অভাব রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদের বিভিন্ন কমিটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
গণতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অধিকার নিয়ে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার কথা বলেছেন। এই সরকারের পুরো মেয়াদে নাগরিক সমাজ মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে অধিকতর বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যম সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে চলছে। বহু খবর তারা প্রকাশ করে না। এ অবস্থায় সামাজিকমাধ্যমে মতপ্রকাশ করেও অনেকে সরকারি খড়গের মধ্যে পড়ছেন। অন্য দিকে, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার অধিকার একেবারে সীমিত করা হয়েছে। রাস্তায় যেকোনো ধরনের কর্মসূচি নির্মম কায়দায় দমন করা হয়। এর সর্বশেষ নজির হিসেবে ভোলায় বিরোধী দলের দু’জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নির্বাচনকালে নাগরিক সমাজের কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক চর্চার পরিধি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনার।
গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সরকারি হেফাজতে নির্যাতন নিয়ে এতদিন দেশে একটি গুমোট অবস্থা ছিল। কেউ একজন এর শিকার হলে বিচার প্রশাসনের কোনো পর্যায় থেকে এর দায় স্বীকার করার কাউকে পাওয়া যেত না। এগুলো একেকটি ভুতুড়ে ঘটনা হিসেবে গোপনে আলোচনার বিষয় হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের সফর এ ধরনের ঘটনা রোধে কাজে আসবে বলে আমরা আশা করতে পারি। তাছাড়া এ ব্যাপারে তার সরেজমিন পর্যবেক্ষণের পর দেয়া পরামর্শ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতির উত্তরণে এ নিয়ে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এ ধরনের বেআইনি কাজে যাতে না জড়ায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কিভাবে মোকাবেলা করবে, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশন। আমরা আশা করব এ ক্ষেত্রেও অগ্রগতি সাধিত হবে। সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমরা এরপর অগ্রসর হতে পারব বলে আশা করা যায়।


আরো সংবাদ



premium cement