২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
শিক্ষককে হত্যা করেছে ছাত্র

আমাদের সামগ্রিক অবক্ষয়

-

সংবাদমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে- এক ছাত্র পিটিয়ে তার শিক্ষককে হত্যা করেছে। সাভারের আশুলিয়া হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটনাটি ঘটেছে। ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে উৎপল কুমার নামে ওই শিক্ষককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে দশম শ্রেণীর ছাত্র আশরাফুল ইসলাম। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে তিনি মারা যান। আশরাফুলের বিরুদ্ধে পাওয়া যাচ্ছে অনেকগুলো অভিযোগ। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে চলা নৈরাজ্য ও অনৈতিকতারই বহিঃপ্রকাশ শিক্ষক হত্যার এ ঘটনা। উৎপল খুনের ঘটনাও হয়তো অনুল্লেখযোগ্য থেকে যেত যদি তিনি মারধরের শিকার হওয়ার পর সুস্থ হয়ে যেতেন। আশরাফুল শিক্ষক পেটানোর যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে এমন অন্যায়, সন্ত্রাস ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অহরহ ঘটে চলেছে। সেসবের প্রতিকারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো আমাদের নেই।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক হত্যার ঘটনাটি গুরুতর হিসেবে দেখছে। এমন ঘটনা অবশ্যই গুরুত্ব পাওয়ার কথা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটা প্রত্যেকটি অপরাধকে একই মাত্রায় দেখা উচিত। সেটি আমরা পারিনি, পারছি না। আজকে সারা দেশে প্রায় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় ধরনের অবক্ষয়ের মধ্যে পতিত হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে খবর পাওয়া যায়, আশরাফুল অত্যন্ত বেপরোয়া ও রগচটা স্বভাবের। সে ছাত্রীদের নিয়মিত উত্ত্যক্ত করত। স্কুলের সহপাঠীদের সাথে করত দুর্ব্যবহার। ছাদের তালা ভেঙে ফেলা ও সীমানা প্রাচীর টপকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে সে। স্কুলের নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খলা মেনে চলত না। এ ছাড়া অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ধরনের তরুণদের সবাই বখাটে নামে চেনে। শিক্ষককে পেটানোর আগে অনেকগুলো অপরাধ সে ধারাবাহিকভাবে করেছে। এগুলোর কোনোটির জন্যই তাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হয়নি। পুরো দেশ এ বখাটেদের উৎপাতে তটস্থ। কিশোর গ্যাং নামে সংঘটিত হয়ে এরা ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে- এই শ্রেণীর উঠতি বয়সী তরুণদের সময়মতো শাসন করা হচ্ছে না। এ জন্য আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা প্রধানত দায়ী। এ ঘটনাটিকে আমরা যদি কেবলই একজন ছাত্রের শিক্ষক হত্যা হিসেবে দেখি তাহলে বড় ভুল করে বসব। শিক্ষক উৎপল বেঁচে গেলে আশরাফুলের আগের করা অপরাধগুলোর মতো একটি অপরাধ হিসেবেই এটি বিবেচিত হতো। এর জন্য তাকে কোনো ধরনের উপযুক্ত বিচারের মুখোমুখি হতে হতো না। তাকে তাই কোনো শাস্তিও পেতে হতো না। এরপর হয়তো দেখা যেত, স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাকে আরো বেশি সমীহ করা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ছাত্ররা তাকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করে চলে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা পাঠ্যবই অধ্যয়নের পাশাপাশি উন্নত নৈতিক শিক্ষা পাবে। বাংলাদেশেও এমনটিই চালু ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের শিক্ষায় এর ব্যাপক ধস নেমেছে। স্কুল-কলেজে ছাত্রদের একটি অংশ বখাটে হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের মর্যাদাকে এখন আরো খাটো করে দেখা হচ্ছে। শ্রদ্ধা-সম্মান ও নমনীয়তায় পূর্ণ শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের ভারসাম্য উল্টে যাচ্ছে। শিক্ষককে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়া, কেরোসিন ঢেলে হত্যার হুমকি, জুতার মালা পরানোর দাবি- এসব এখন সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সরকারি ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাস ও অনিয়মের বিরুদ্ধে অনশনে বসেছেন। প্রতিষ্ঠানটির হল প্রশাসন ছাত্রলীগের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। হলের সিট বণ্টনসহ সব ধরনের কার্যক্রমে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। সাধারণ ছাত্রদের প্রায়ই হল থেকে বের করে দিচ্ছে। অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না।
দশম শ্রেণীর ছাত্রের শিক্ষক হত্যাকে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে নিলে এর প্রতিকার কখনো পাওয়া যাবে না। এ ঘটনাকে খুন হিসেবে দেখলে আমরা হয়তো আলাদাভাবে আশরাফুলের বিচার ও শাস্তি দেখতে পাবো। কিন্তু এতে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক লাঞ্ছনা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের যে উৎসব চলছে তা বন্ধ হবে না। এ জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে চরম অবক্ষয় নেমে এসেছে প্রথমে তা স্বীকার করে নিতে হবে। অপরাধী ছাত্রদের বিচার করে তাদের দৌরাত্ম্য সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। তাহলেই কোনো সন্ত্রাসী ছাত্রের মুখোশ পরে আর কোনো অন্যায় করতে পারবে না। তাতে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের মর্যাদা ফিরবে আশা করা যায় ।

 


আরো সংবাদ



premium cement