১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত

বাণিজ্যই যেখানে মুখ্য

-

১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবায় জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারি হাসপাতাল খুবই কম। স্বাভাবিকভাবে এই প্রয়োজন মেটাতে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতে গড়ে উঠেছে বহু হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বেসরকারি খাতে এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আমাদের জনস্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষ করে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কয়েকটি উন্নতমানের হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এগুলোতে অপরাপর দেশের উন্নত স্বাস্থ্যসেবার মতো চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে আগে যে বিপুলসংখ্যক রোগী প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতেন, এখন সে প্রবণতা আগের চেয়ে কমে এসেছে। এতে করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। তবে এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার জনস্বাস্থ্যে অবদান রাখছে এ কথা স্বীকার করেও বলতে হয়- এগুলোর বেশির ভাগের সেবার মান যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, ঠিক তেমনি সেবা খাতে বিনিয়োগ করলেও মালিকপক্ষের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে শুধু বাণিজ্য প্রসারের দিকে। সেবার মান রক্ষা সেখানে গৌণ যার কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত রোগী এবং তাদের স্বজনদের হয়রানি এবং প্রতারিত হতে হচ্ছে। এ ধরনের খবর গণমাধ্যমে হরহামেশাই প্রকাশ পাচ্ছে।
বাস্তবতা হলো- দেশে গড়ে ওঠা বিপুলসংখ্যক বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে সরকার এখনো সম্পূর্ণভাবে কঠোর নিয়মের মধ্যে আনতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে- বেসরকারি হাসপাতালে অনেক সময় রোগীরা প্রতারিত হলেও হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া আর কেউ প্রতিকার পাচ্ছেন না। বাস্তবে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকপক্ষ এমন সব কর্মকাণ্ড করে বসছেন, যাতে মানবিকতার কোনো ছোঁয়া নেই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অবলীলায় তারা রোগী ও তার স্বজনের সাথে অমানবিক সব কর্মকাণ্ড করছেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, নির্মম সব ঘটনা ঘটিয়েও তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। এমনই একটি নির্দয় ও নির্মম ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত ‘আমার বাংলাদেশ’ নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ওই ঘটনার নির্মমতা এমনই যে, তাতে যেকোনো মানবিক গুণসম্পন্ন সংবেদনশীল মানুষ হতবাক না হয়ে পারেন না।
সহযোগী একটি পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভোগা ছয় মাসের যমজ দুই শিশুসন্তানকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন এক মা। পরে দালালের খপ্পরে পড়ে ২ জানুয়ারি ওই শিশুদের শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ’ নামের বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে যমজ শিশুর পাঁচ দিনে চিকিৎসার বিল করা হয় এক লাখ ২৬ হাজার টাকা। গত বৃহস্পতিবার যমজ শিশুর অসহায় মা পুরো টাকা না দেয়ায় হাসপাতালটির মালিক যমজ শিশুর মুখ থেকে অক্সিজেনের নল খুলে দেন। ভুক্তভোগী মার অভিযোগ, নল খুলে নেয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই তার যমজ শিশুর একটি মারা যায়। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই মা নিজের ইচ্ছায় তার সন্তানদের নিয়ে গেছেন। হাসপাতালের পুরো বিলও তিনি পরিশোধ করেননি।
দেশের সংবেদনশীল নাগরিকদের মতো আমরাও মনে করি, দেশের জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এ খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা অতি মোনাফার ঘেরাটোপে বন্দী। ফলে দেখা যায়, তারা অসহায় রোগীদের পণবন্দী করে শুধু অর্থ উপার্জনকেই মুখ্য করে নিয়েছেন। তাদের চিন্তায় এই বিবেচনাবোধ লুপ্ত হয়ে গেছে যে, চিকিৎসা খাত সেবামূলক। এ খাতের বিনিয়োগকারীদের সেবার মানসিকতা থাকতে হবে সর্বপ্রথম; এই বোধ-বুদ্ধি যে অনেকেরই নেই, তাদের আচরণই তা বলে দেয়। জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কঠোর নিয়মের মধ্যে আনার কোনো বিকল্প নেই। সাথে সাথে ‘আমরা বাংলাদেশ’ হাসপাতালে যে নির্মম ঘটনার অবতারণা হয়েছে, সে বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের উপযুক্ত বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তা হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হবে বলে আশা করা যায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement