১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
নারীর প্রতি আগ্রাসী আচরণ বেড়েছে

মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়

-

একটি সমাজে নারীর ওপর পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে সেটি সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করে। কলাগাছ থেকে কেউ আম প্রত্যাশা করে না। সমাজের মানুষ হঠাৎ করে উদয় হচ্ছে না। প্রত্যেকটি প্রজন্ম তাদের আগের প্রজন্মের কাছ থেকে শিখছে। আগের প্রজন্ম যা যেভাবে শেখাবে পরের প্রজন্মের মানুষ তারই প্রতিলিপি হবে। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিগত কয়েক দশকে এমন পর্যায়ে গেছে, এ সমাজের মানুষ ‘পেটভর্তি’ ঘৃণা নিয়ে বড় হচ্ছে। মানুষ মতামতের দিক দিয়ে বড় আকারে কয়েকটি রাজনৈতিক মঞ্চে বিভক্ত। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের প্রতি কোনো ধরনের অঙ্গীকার বোধ করে না। যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে তারা বাকিদের আগ্রাসীভাবে বঞ্চিত করছে, অবহেলা করছে। আর সমাজ অনিয়ম-অনাচার, দুরাচার-দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে গেছে। এ ধরনের অসহিষ্ণু একটি সমাজ পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন ও শিষ্টাচার হারিয়ে যায়। নারীদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ কিভাবে করতে হবে সেটি আমাদের মধ্যে থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি বেসরকারি সংস্থা নারীর প্রতি কেমন আচরণ হচ্ছে সে বিষয়ে জরিপ চালিয়েছে। পারিবারিক বলয়, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও জনসমাগমস্থলে জরিপ চালিয়েছে। গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত আটটি বিভাগের শহর ও গ্রামের চার হাজার ৩০৫টি পরিবারের ওপর জরিপটি চালানো হয়। মা-বাবা, কিশোর ও কিশোরীÑ এই চার শ্রেণীতে জরিপটি চালানো হলে দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গবিদ্রƒপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অশালীন, ক্ষতিকর মন্তব্যের মাধ্যমে নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে ৫৭ শতাংশের বেলায়। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে তরুণী ও নারীরা বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
২৫ নভেম্বর থেকে ১৬ দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ উপলক্ষে জরিপটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন। এদের মধ্যে ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ মানসিক বিষাদে ভোগেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতার শিকার ছাত্রীদের ৯০ শতাংশ হতাশায় ভোগেন। অনেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। কর্মক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদের ২৬ শতাংশ কাজে যাওয়া বন্ধ করে দেন। অনলাইনে হয়রানির শিকার মেয়েদের ৭৮ শতাংশ মানসিক চাপে ভোগেন। সবমিলিয়ে এ দেশের বেশির ভাগ নারী সমাজের পুরুষ সদস্যদের পক্ষ থেকে সদাচরণ পাচ্ছেন না।
প্ল্যানের জরিপটি শুধু নারীদের ওপর চালানো হয়নি। তবে এতে উঠে আসা ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজের নারীরা অনেক বেশি চাপের মুখে রয়েছেন। তারা গড়পড়তা একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ জন্য আমরা বিচ্ছিন্নভাবে পুরুষদের অন্যায় আগ্রাসী লোভী আচরণকে দায়ী করলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। আমাদের দেশে অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে এমন আলাদাভাবে ঘটনার মূল্যায়ন করতে হবে। পরিবার, সমাজ ও অন্য সব জায়গায় নারীদের নিরাপদ করতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে অন্যায়-অনিয়ম ও অনাচারের চর্চা করে আমরা যদি নারীদের প্রতি সদাচরণের সবক দিতে চাই, সেটি কোনোভাবেই কার্যকর হবে না। এ দেশে বিগত ৫০ বছরে নারীদের প্রতি আগ্রাসী আচরণ কমছে না, বেড়েছেÑ এমন কোনো জরিপ চোখে পড়েনি। তবে এ ধরনের জরিপ হলে এটি স্পষ্ট জানা যাবেÑ আমাদের সমাজে নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি অনিরাপদ। শুধু নারী নন, সমাজের প্রবীণরাও বাকি সদস্যদের কাছ থেকে সঠিক আচরণ পাচ্ছেন না। এমনকি সব শ্রেণীর মানুষের শিষ্টাচারজ্ঞান আগের চেয়ে লোপ পেয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। ঘৃণার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। নারী ও পুরুষের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের শিক্ষার মধ্যে আনতে হবে। প্রকৃত মূল্যবোধই পরিস্থিতি বদলাতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement