২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
রাগে-দুঃখে বাইকে আগুন

অসহায়ত্বের বার্তা

-

সরকারি বয়ানে দেশে যে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছেÑ এর সুফল সবাই সমভাবে পাচ্ছেন সে কথা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। বাস্তবে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। সেই বাস্তবতা একটু একটু করে দৃশ্যমান হচ্ছে। করোনাকালে ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান আরো বেড়ে গেছে। সরকারি হিসাবেই বলা হচ্ছেÑ মহামারীপূর্ব দেশে ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। এখন বেড়ে হয়েছে ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ এ মুহূর্তে দেশে গরিব মানুষ প্রায় পাঁচ কোটি। করোনার প্রভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ জীবিকা হারিয়ে দুর্বিষহ বেকার জীবনে নিপতিত। তাদের অনেকে দিশেহারা। এসব অসহায় মানুষের এখন টিকে থাকাই দায়। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে রাইড শেয়ারিংয়ে নেমেছেন। কিন্তু তাতেও বাদ সাধছে ট্রাফিক পুলিশের আইনকানুন। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলোÑ প্রত্যেক নাগরিকের জীবিকার ব্যবস্থা করা এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র যে নাগরিকবান্ধব নয়; এর প্রমাণ মেলে রাজধানীতে প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে গত সোমবার শওকত নামের এক যুবক নিজের বাইকে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায়। এটি আমাদের কাছে মামুলি কোনো ঘটনা বলে মনে হয়নি। কারণ, শওকতের মতো অবস্থা বেশির ভাগের। তাদের হৃদয়ে জ্বলছে হতাশার আগুন।
ঢাকা শহরে একজন বাইকচালকের মনে সেই আগুনই জ্বলেছে। পুলিশ মামলা দিতে তার বাইকের কাগজপত্র নিয়ে যায়। কাকুতি-মিনতি করে কিছুতেই কাজ হয়নি। শেষে মোটরসাইকেলটিতে আগুন ধরিয়ে দেন প্রকাশ্য দিবালোকে, পুলিশসহ সবার সামনে। গত বছর টাঙ্গাইলের এক কৃষক ধানের দাম নেই দেখে, ধান কাটার মজুরি জোগাতে না পেরে রাগে-দুঃখে পাকা ধানের মাঠে আগুন লাগিয়ে দেন। কৃষকরা প্রতি বছরই আলু কিংবা সবজির দাম না পেয়ে ফেলে দেন যতেœ ফলানো শস্য। গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, ছোটখাটো ব্যবসা ছিল শওকতের। কিন্তু করোনার বিধিনিষেধে ব্যবসায় মার খায়। তখন বাইকটি হয়ে ওঠে তার আয়ের উৎস। পরিবারের ভরণপোষণে রাইড শেয়ারিংয়ে নামেন। মোটরসাইকেলটিই ছিল সম্বল। বাইক না চললে যে আহার জুটবে না।
করোনাকালে যারা কাজ হারিয়ে পাঠাও বা উবারের চালক হয়েছেন, তাদের সবার মনের আগুনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে শওকতের ক্ষোভে-দুঃখে। ঘাটে ঘাটে মার খাওয়া অসহায় কর্মজীবীদের প্রতীক হলেন তিনি, এটিই এখনকার বাস্তবতা। যারা কারণে-অকারণে আইনের নামে পুলিশের অন্যায় আচরণ মুখ বুজে সহ্য করছেন, তাদের ভাবনাÑ এভাবে আর কত দিন। দিনের পর দিন অপমান-নির্যাতন সইতে সইতে শওকত নিজের ক্ষতি করে হলেও প্রতিবাদ করেছেন।
বাংলায় ‘রাগে-দুঃখে’ বলে একটি শব্দবন্ধনী আছে। সাধারণত রাগ হয় অপরের প্রতি, দুঃখ হয় নিজের প্রতি। যখন অন্যের প্রতি রাগের জবাব দেয়া সম্ভব হয় না, প্রতিকার করা যায় না, তখন যে দুঃখের আগুন মনোজগতে জ্বলে ওঠে, তা প্রকাশ করতে আমরা এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করি। বর্তমানে বাংলাদেশের বহু মানুষ এমন রাগে-দুঃখে জর্জর অবস্থায়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতেও দেখা যায়, শওকত চিৎকার করছেন, ছোটাছুটি করছেন। এটা হতো না, যদি ভালো আছে বলে মনে করছেন যারা, তারাও নির্যাতিতদের রাগ ও দুঃখের সাথে শামিল হতেন। সেই সহমর্মী জনতার অভাবেই একজন শওকত নিজের ক্ষতি করে আশাবাদ উবে যাওয়া অসহায়ত্বের বার্তাটা দিয়ে গেলেন।
দেশে সুশাসনের অভাবে যে সাধারণ নাগরিকের মন হয়ে উঠতে পারে দাহ্য; সামান্য স্ফুলিঙ্গে জ্বলে উঠতে পারে দাউ দাউ করে আগুন সে খবর রাষ্ট্র রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না। অথচ সুশাসনই পারে সাধারণের মনের এ আগুন নেভাতে। কিন্তু সেই সুশাসন আমাদের কাছে এখন শুধুই ‘সোনার পাথরবাটি’। নিকটভবিষ্যতেও যা অধরাই থাকবে বলে মনে হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement