২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত

কথা বলার সুযোগ দিতে হবে

-

প্রাণীদের মধ্যে মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কষ্ট দুঃখ চিন্তা ও ভাবনা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারা। প্রতিনিয়ত মানুষ এর দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করে হালকা বোধ করে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশেই নানা মাত্রার স্বেচ্ছাচারী শাসকের আবির্ভাব হচ্ছে। তারা নাগরিকদের স্বাভাবিক মতপ্রকাশের আনুষ্ঠানিক সুযোগগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করা, সভা-সেমিনার করা কিংবা মিডিয়ায় নিজেদের বঞ্চনার কথা বলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই সময় আবার বিকল্প মাধ্যমেরও বিস্ফোরণ ঘটেছে। অনলাইনের এ অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে মানুষ নিজের বঞ্চনার কথা প্রকাশ করে স্বস্তি পেতে চায়; কিন্তু অনলাইনে মতপ্রকাশের সুযোগও অনেক দেশের শাসকরা চেপে ধরতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও বেশ এগিয়ে।
আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজের এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত সময়ে অনলাইনের ব্যবহার নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। ইন্টারনেটে স্বাধীনতা সূচকের মোট নম্বর ১০০। বাংলাদেশ পেয়েছে ৪০ পয়েন্ট। গত বছর পেয়েছিল ৪২। ২০১৯ সালে পেয়েছিল ৪৪ ও ২০১৮ সালে পেয়েছিল ৪৯। সূচকের প্রাপ্ত নম্বর বলছে, বাংলাদেশে ডিজিটাল প্লাটফর্মে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। প্রাপ্ত পয়েন্টের ভিত্তিতে তিনটি শ্রেণী তৈরি করেছে তারা। যদি নম্বর ১০০ থেকে ৭০ এর মধ্যে থাকে তাহলে মুক্ত অনলাইন। ৬৯ থেকে ৪০ হলে আংশিক মুক্ত অনলাইন। প্রাপ্ত নম্বর ৩৯ এর নিচে হলে দেশটির অনলাইন মুক্ত নয়। ভাগ্য ভালো আমরা মাত্র এক নম্বর বেশি পেয়ে তালিকার একেবারে নিচে অবস্থান করিনি। তবে এ ধরনের তালিকা করার সময় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। দেখা যাবে অনেক ক্ষেত্রে অনলাইনে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা তালিকার সর্বনিম্ন স্তরের দেশগুলোর চেয়ে ভালো নেই। এ তালিকায় প্রতিবেশী দেশ ভারত ৪৯ নম্বর পেয়ে এবং শ্রীলঙ্কা ৫১ নম্বর পেয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
ফ্রিডম হাউজের দৃষ্টিতে দু’টি কারণে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নাগরিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আট শতাধিক মামলা হয়েছে। অন্য দিকে সরকারের সাইবার ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবরে আইনটি প্রণয়নের পর থেকে মামলা দায়ের হয়েছে দুুই হাজার। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজে অভিনব সব উপায়ে অনলাইনে নজরদারি করছে। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাধা, ওয়েবসাইট বন্ধ, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি। অন্য দিকে সরকারের পক্ষের প্রচারণাকারীরা দলবল নিয়ে নামছে। বিরোধীদের ওপর কারিগরি হামলা করা হচ্ছে। সবশেষে নেমে আসছে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও আটকের মতো ঘটনাও। ফ্রিডম হাউজের রিপোর্টের বাইরেও সাধারণভাবে আরো অনেক অভিযোগের কথা জানা যাচ্ছে। অনলাইনে জনপ্রিয় অনেক ব্যক্তির ব্যবহৃত সামাজিক মাধ্যম ও ইউটিউব চ্যানেলে অনাকাক্সিক্ষত বাধা আসছে। অনেকের চ্যানেলের রিচ কমে যাচ্ছে। অনেকে ব্লক হয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের অসুবিধা সৃষ্টির কথা সবসময় শোনা যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় সারা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তখন সরকার তিন দিনের জন্য ফেসবুক ও ফেসবুক মেসেঞ্জার বন্ধ করে দেয়।
এই তালিকায় আইসল্যান্ড ৯৬ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষে রয়েছে। তাদের প্রাপ্ত পয়েন্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে, একটি দেশের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা অবারিত হতে পারে। অন্য দিকে বাংলাদেশের মতো আরো কিছু দেশ রয়েছে যারা নানা ফন্দিফিকির করছে মানুষের মতপ্রকাশকে কিভাবে আরো সঙ্কুচিত করা যায়। এর মধ্যে জানা গেল, বাংলাদেশ ইসরাইল থেকে নজরদারি সিস্টেম ক্রয় করেছে। এর দ্বারা মানুষের মোবাইল হ্যাক করে ব্যক্তিগত তথ্য গোপনে সংগ্রহ করা যায়। আমরা আশা করব, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সরকার শ্রদ্ধাশীল হবে। ডিজিটাল দুনিয়াকে অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রিত করার বদলে একে সুস্থভাবে বিকশিত হওয়ার প্রণোদনা দেবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement