১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ঠাণ্ডা মাথায় মা-বাবা বোনকে খুন

সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি

-

বাংলাদেশের সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবক্ষয় দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক এখন এতটাই জটিল হয়েছেÑ সহনশীলতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। প্রতিপক্ষ কিংবা নিজের কল্পিত শত্রু কিংবা পথের কাঁটা খোদ দুনিয়া থেকে সরাতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে না অনেকে। পরস্পরের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ পুনরায় সম্প্রীতি ও সদ্ভাবে রূপান্তরের চিন্তা তাদের মাথায় আসছে না। সর্বশেষ রাজধানীতে এক নারী ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছেন বাবা-মা ও বোনকে। নিষ্ঠুর এই ঘটনার পুলিশি প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে নানামাত্রিক অবক্ষয়ের প্রভাবে একান্ত আপনজনকে এমন নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
রাজধানীর কদমতলীতে মাসুদরানা স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন। গত শনিবার তার অন্য মেয়ে অভিযুক্ত মেহজাবিন ইসলাম মুন পুলিশের জরুরি নাম্বারে ফোন দিয়ে জানান, ‘বাবা-মা ও বোনকে হত্যা করেছি।’ বিস্তারিত বিবরণে জানা যায়, ঘটনার সময় মুনের স্বামী ও শিশুসন্তান ওই বাসায় ছিল। তিনি ঘরের পাঁচজনকেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করেন। এরপর বাবা-মা ও বোনকে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। প্রাথমিক স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, পরিবারের সদস্যদের ওপর ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন তিনি। ছোট বোনের সাথে স্বামীর সন্দেহজনক সম্পর্কের কথাও বলেছেন। আরো বলেছেন, ভারতীয় একটি সিনেমা দেখে প্রথমে সায়ানাইড প্রয়োগ করে তাদের হত্যার পরিকল্পনা করেন। সায়ানাইড সংগ্রহ করতে না পেরে ভারতীয় ‘ক্রাইম পেট্রোল’ সিরিজ দেখে হত্যার ছক আঁটেন। জানা যায়, এর আগে একবার শরবতের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাদের হত্যা করতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হন। তিনি তার প্রথম স্বামী হত্যার দায়ে পাঁচ বছর জেল খেটেছেন। ওই ঘটনায় তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল।
ঘটনাটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিশেষ করে পারিবারিক হত্যা যখন বেড়েই চলেছে। প্রণয়সহ অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কের কারণেও খুনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। কয়দিন আগে পরকীয়ার জেরে আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটে কুষ্টিয়ায়। পুলিশের এক উপপরিদর্শক প্রকাশ্যে গুলি করে স্ত্রী, স্ত্রীর শিশুসন্তান ও প্রেমিককে হত্যা করেন। কদমতলীর এ হত্যার সাথে কুষ্টিয়ার ট্রিপল খুনের ঘটনার কিছুটা মিল রয়েছে। মুন নিজের মা-বাবা ও বোনকে হত্যার পর স্বাভাবিক। পরবর্তী পরিণতি নিয়ে তিনি ভাবিত নন। যেমনটা কুষ্টিয়ার ওই পুলিশের আচরণের মধ্যেও রয়েছে। সমাজে এ ধরনের ঘটনার ছড়াছড়ির মধ্যে সেই সমাজের অস্থিরতার চিত্র স্পষ্ট। এ দুই ঘটনা মোটা দাগে ঘটলেও ঠিক এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। সেগুলো শুধু প্রচলিত আইনে বিচার কাঠামোর মধ্যে আনলেই এই অসুস্থ সামাজিক অবস্থার উত্তরণ ঘটবে না। এ খুনিরা কেন বর্বর হয়ে উঠছেন তার পেছনের কারণ খতিয়ে দেখতে হবে।
মুনের বাবা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে ছিলেন। অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে তিনি বেপরোয়া জীবনযাপন করার সুযোগ নেন। পারিবারিক পরিবেশের দুর্বলতার বিষয়টি এর মাধ্যমে বোঝা যায়। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষাসহ সামগ্রিক ব্যবস্থায় মানবিক গুণাবলি অর্জনের বিষয়টি এখন অবহেলিত। এ ছাড়া নাটক, সিনেমা ও বিদেশী সিরিজ যেগুলো মানুষকে নিষ্ঠুরতায় উদ্বুদ্ধ করছে। শিক্ষা যখন মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলছে না, এ সময়ে অবাধে এমন নেতিবাচক সংস্কৃতির প্রভাব সেটাকে আরো জোরালো করছে। পাশাপাশি কেবল বস্তুগত উন্নতির যে দর্শন দেশে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে; সেটাও পরিবেশের দ্রুত অবনতি ঘটাচ্ছে। জমিজমার বিরোধ এবং বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের কারণেও সমাজে মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনা অহরহ ঘটছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি থেকে রক্ষা পেতে পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে এখনই জোর দিতে হবে। এটি করতে হলে সরকার, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন এমন ব্যক্তিবিশেষ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সমানতালে।

 


আরো সংবাদ



premium cement