১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
পাচারকারীর খপ্পরে হাজারো বাংলাদেশী

দুষ্কৃতচক্র ভাঙতে কঠোর হতে হবে

-

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশ উঠে এসেছে। দেশে বিপুল উন্নয়ন হচ্ছেÑ সরকারি এমন বয়ান সত্ত্বেও বাস্তবতা হলোÑ এখনো কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতি বছরই হাজারো বাংলাদেশী উন্নত জীবনের আশায় অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। বিশেষ করে ইউরোপে বিপদসঙ্কুল সাগরপথে পাড়ি জমাচ্ছেন তারা। এরা প্রায় সবাই বয়সে তরুণ। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি অংশ যে উন্নত দেশগুলোতে অনুপ্রবেশ করতে পারছে না, তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটছে। মানবপাচারকারী চক্র বিদেশগামীদের প্রত্যাশা পুঁজি করে ঝুঁকিপূর্ণ পথে পাচার করছে। রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক বনে যাওয়া যায় বিধায় পাচারকারীচক্র সবসময়ই থাকে বেপরোয়া।
লিবিয়া ও তিউনিশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রার ক্ষেত্রে নৌকা ডুবে প্রায়ই অভিবাসনপ্রত্যাসীদের মৃত্যুর খবর শোনা যায়। ওই দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটকও হন অনেকে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। আর গ্লোবাল মিডিয়ার খবর, গত পাঁচ মাসে বিভিন্ন দেশের ১০ হাজার ১৫৪ অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ইউরোপ যাওয়ার প্রাক্কালে আটক করে লিবিয়ান কোস্টগার্ড। ১৭৩ জন মারা গেছেন। ৪৫৯ জন এখনো নিখোঁজ। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগেরই সলিল সমাধি হয়েছে। এরপরও বিপজ্জনক এ পথে ইউরোপ পাড়ি জমানোর প্রবণতা থামছে না। এএফপির এক প্রতিবেদনের মূল্যায়ন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার আশা ছাড়াও যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ যাত্রার প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। লিবিয়া রুটে আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের তৎপরতায় বিস্তীর্ণ সাব-সাহারা পাচার রুট ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকালে মারা যাওয়া কিংবা মৃতের ঘটনা এতই বেড়েছে যে, তিউনিশিয়া উপকূলের কাছে রীতিমতো একটি সমাধিক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়েছে।
লিবিয়া-তিউনিশিয়া রুটে এখন ইউরোপে লোক পাঠানোর ভরা মৌসুম চলায় এ প্রবণতা আরো বেড়েছে। আইওএম’র তথ্যমতে, মানব পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার হওয়া ১৬০ বাংলাদেশী গত মে মাসে আইওএমের সহায়তায় দেশে ফিরেছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত সংস্থাটির সহায়তায় ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া দুই হাজার ৯০০ বাংলাদেশী লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন। গত এক মাসেই ওই পথে উদ্ধার হয়েছেন ৫২৯ বাংলাদেশী। তিউনিশিয়াতেই উদ্ধার হয়েছেন ৪৪৩ জন। শুধু বৃহস্পতিবারই দেশটির উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয় ১৬৪ জনকে।
ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, সমুদ্রপথে ইউরোপে প্রবেশের অপেক্ষায় হাজার হাজার বাংলাদেশী এখন লিবিয়ায়। দেশটির বিস্তীর্ণ মরুভূমির অর্ধশতাধিক শিবিরে স্থানীয় দালালদের জিম্মায় তারা অবস্থান করছেন। চলতি বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক পাচারচক্র মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসনপ্রত্যাশী এসব বাংলাদেশীকে লিবিয়ার বিভিন্ন উপকূলে জড়ো করে। তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে এপ্রিল এবং মে মাসে ইউরোপগামী নৌকায় তোলা হয়। লিবিয়ান কোস্টগার্ড এবং অন্য বর্ডার এজেন্সির হাতে এক মাসে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশী আটক হয়েছেন। দেশটির আশ্রয়শিবিরে তাদের রাখা হয়েছে। লিবিয়া উপকূল থেকে এত বেশিসংখ্যক বাংলাদেশী উদ্ধারের ঘটনা সম্ভবত এটাই প্রথম। বাংলাদেশ থেকে তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল ইতালি। ঢাকা থেকে বিমানে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে গৃহযুদ্ধকবলিত লিবিয়ায় পৌঁছান তারা। এরপর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরের দুর্গম পথে যাত্রা ইতালির উদ্দেশে।
বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক আইনে মানবপাচার একটি ভয়াবহ অপরাধ। কিন্তু এর পরও পাচারকারীচক্র ভয়ঙ্কর শক্তিশালী। কোনোভাবেই এদের দমানো যাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ, দেশে দেশে ক্ষমতাসীনদের একটি অংশকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এই চক্র। অনেকে রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় এমন অপকর্মে জড়াচ্ছেন। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাজনৈতিক টাউটদের আশকারায় নারী ও মানবপাচারকারীদের এই বাড়বাড়ন্ত। এদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর বিকল্প নেই। অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজের লোক দেখার মানসিকতা পরিহার জরুরি বৈকি।


আরো সংবাদ



premium cement